Monday, 12 March 2018

মিশন শান্তিনিকেতন

বিভিন্ন ভার্চুয়াল, এবং মুখোমুখি আড্ডায় বন্ধুরা মাঝেমধ্যেই  কিশোর ও প্রাক কৈশোর বেলার গল্প লেখার দাবী করেছে, ও করছে। সেই সমস্ত ঘটনার তারা যৌথ সাক্ষী,এবং বহু আসরে আমাদের সেই সুখী ঘোঁতঘোঁত অন্যান্য গল্পগাছাকে বীরদর্পে থামিয়ে দিয়েছে।

বেশ,হোক শুরু। তবে মাথায় রাখতে হবে,যে এর মধ্যে এমন অনেক ঘটনাও থাকবে,যা অনেক বন্ধুই জানবে না,কারন বন্ধুত্ব স্কুলতুতো,কোচিংতুতো,ফ্ল্যাটতুতো, পাড়াতুতো ইত্যাদি নানা গোত্রের হতে পারে কিনা,তাই।

 যাদের গপ্পো বলা হবে তারা সকলেই বাস্তব চরিত্র এবং ঘটনা গুলিও ঘোর বাস্তব। সুতরাং যেকোনো রকম মিল সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে,যে  কারুর কাছে কোন দু:খপ্রকাশ করার দায় নেই আমার।

বন্ধু চল ১

মিশন শান্তিনিকেতন

এ হলো সেই সময়ের কথা,যখন আমরা স্কুল লাইফের বাধোবাধো ভাব ছেড়ে কলেজ জীবনের উদ্দামতায় ঢুকে পড়ে নিজেদের যথোচিত লায়েক মনে করছি। যদিও সত্যি হলো,যে বিদ্যালয় জীবনের ভীরুতা গা থেকে তখনো খসে পড়েনি -  অর্থাৎ ফার্স্ট ইয়ার। ঠিক এই কারনেই  বেড়াতে যাবার প্ল্যান করার সময়ে সবার আগে মনে পড়ে গেছে স্কুলে পড়া আর কোচিং বন্ধুদের,যাদের হয়তো কলেজ আলাদা কিন্ত স্কুল বন্ধুত্ব অটুট।  আমাদের পকেট তখন নিউটাউন action plan 3- অর্থাৎ ইতিউতি ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স  হলেও অধিকাংশই ফাঁকা মাঠ। কিন্ত মেজাজটাই তো আসল রাজা - তাই টাকাকড়ি কম থাকলেও ডোন্ট কেয়ার।

ক্রীশমাসের ছুটি। কোথাও বেড়াতে না যাওয়াটা একটা পাপ। কিন্ত  একইসাথে দৃশ্যসুখ আর পকেটের সুখ উপভোগ করা যেতে পারে এমন কোন জায়গা আছে কি? সিগারেট কিনতে দশ কিলোমিটার ঠ্যাঙাতেও হবেনা,আবার গায়ে ঘষটানো ভীড় ঠেলতেও হবে না সারাক্ষণ,এই জাতীয় কোন মোকাম? ভাবনাচিন্তা করে দেখা গেলো : আছে আছে স্থান!! সেখানে পৌষমেলার মোচ্ছব। সেখানে বিদুষী মামনিদের হাট। সঙ্গে ফাউ হিসেবে চনমনে ঠান্ডা আর খোলা আকাশ। বাবা তখন সদ্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, মানে থাকার খরচা নেই। সেবারের ছুটিতে তাই ঠিক হলো, যে বাঙালী সংস্কৃতির এই মদিনায় আমাদের দিগ্বিজয় সাধিত হবে।এরপরে আর কি? "আয়ায়ায়া আমাদের শান্তিনিকেতন" বলে নাচতে নাচতে ট্রেনে উঠে পড়ার শুধু অপেক্ষা।
 ( আমার কেন জানি না বহুদিন ধারনা ছিলো যে এই গানটা তোতলাদের জন্য লেখা, যাতে ফার্স্ট লাইনে আটকে গেলে সেটা ম্যানেজ করা যায়)।। আমি দুদিন আগে চলে গেছি বাবা মায়ের সাথে। বন্ধু ব্রিগেড আসবে আমার পিছু পিছু। নামবে প্রান্তিকে ( বোলপুরের পরের স্টেশন) কারন সেখান থেকে ফ্ল্যাট চত্বর হাঁটা পথ। জনা ছয়েক সদ্য ভোটাধিকারপ্রাপ্ত অত:পর দিন দুয়েক বাবা মা সম্মিলনে ভদ্রসভ্য থেকে, তাঁরা কলকাতা প্রস্থান করলেই নিজমূর্তি ধারন করবে। সমস্ত পরিকল্পনা ঠিকঠাক, কিন্ত হায়। রবিঠাকুরের ঠেক যে শুরু থেকেই তাদের প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করবে, সে কি কেউ ভাবতে পেরেছিলো আগে?

বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার যখন প্রান্তিক স্টেশনের হাতায় এসে দাঁড়ালো, শীতালি রোদ্দুর সবে ছোট্ট কাঁচামাটির প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। আমি শাল মুড়ি দিয়ে বন্ধুদের অভ্যর্থনা করবো বলে দাঁড়িয়ে। বীরদর্পে একে একে নামলেন তারা। অনির্বাণ, সন্দীপ,শান্তনু, সৌম্য,বান্টি এবং মৈনাক। সকলের মুখেই চওড়া হাসি,আমিও বেশ একটা রাশভারী হোস্ট ভাব নিয়ে " আয়,আয় কোন কষ্ট হয়নি তো" ভাব করে এগিয়ে গেছি - এমন সময়ে মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন একটি কালো কোট।

বোঝা উচিত ছিলো। অবশ্যই বোঝা উচিত ছিলো বন্ধুদের,যে বোলপুর অব্দি টিকিট কেটে  প্রান্তিকে নামা একটা রিস্ক ফ্যাক্টর। আমারও সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিলো,যে মেলার সিজনে জায়গাটা এক্কেবারে ক্ষুধার্ত হায়নায় ভরে আছে,কারন বহু লোক টিকিট না কেটে এই প্রান্তিকেই নামছে আশ্রমের দূরত্ব যেহেতু এদিক দিয়ে কম। কিন্ত ওই যে - ফার্স্ট ইয়ার।

বন্ধুরা অবশ্য তখনো অকুতোভয়। বুক ফুলিয়ে এগিয়ে দেওয়া হলো টিকিটের তাড়া। কালো কোট তার উপরে একবার তাকালেন। চোখে মুখে ফুটে উঠলো কেমন একটা কসাই কসাই ভাব। তারপর সেই টিকিটের থেকে ক্রুর দৃষ্টি তুলে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন : এ তো বোলপুর অব্দি কাটা আছে। তোমরা তো বোলপুর ছাড়িয়ে এসেছো।

বন্ধুদের মাথায় ব্যাপারটা তখনো, যাকে বলে register করেনি। কিন্ত আমি বুঝেছি। এবং সেই সাথে এটাও বুঝেছি, যে বিনা প্ল্যাটফর্ম টিকিটে ঘোরাঘুরি করছি বলে আমাকেও পাকড়াও করা হতে পারে। তাই " শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ" পোজে একটু সাইডে সরে গেলাম।

কালো কোট আর সময় নষ্ট না করে বললেন : একশো পঁচিশ টাকা।

বন্ধুদের মধ্যে "স্মার্টবয়" অনির্বাণ( সেই একমাত্র ফ্রেঞ্চকাট রাখার স্তরে উন্নীত হয়েছে,বাকী সবার তখনো স্কুলকালীন সেই বন্য গোঁফ সম্বল) পালটা ভাও দেখিয়ে " আপনি রসিদ কাটুন, আমরা দিয়ে দিচ্ছি " গোছের একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কালো কোট মেসির মতো নৈপুণ্যে তার কনফিডেন্সকে ডজ করে জালে বল ঢুকিয়ে দিয়ে বললো :

"একশো পঁচিশ। each. "

আগামী সাতদিনের জন্য তখন প্রত্যেকের পকেটে বরাদ্দ তিনশোটি টাকা। তার মধ্যে খাওয়াদাওয়া আছে, সিগারেট আছে,ঢুকুঢুকুর প্ল্যান আছে,ভ্যান বা রিক্সাভাড়া আছে এবং ফেরার টিকিট কাটতে হবে সেই টাকা থেকেই। এখন পকেট থেকে একশো পঁচিশ বেরিয়ে গেলে ঢুকুঢুকু এবং অন্যান্য বিলাস তো দুরস্থান, শেষ দুদিন হয়তো না খেয়েই...!!!

কালো কোট তখন বন্ধুদের চোখে মোটামুটি ভারতভাগ্যবিধাতা। অতএব প্রায় সমবেত আর্তনাদ সহকারে তার উদ্দেশে আকুল প্রার্থনা আর অনুনয় বিনয়ের বন্যা বয়ে গেলো। এর ফলে তিনি যে কয়েকটি তাজা কিশোরের অনাহারে মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন, সেটাও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হলো একইসাথে।  কালোকোট অবশ্য হীরক রাজার মতো নিষ্ঠুর নন, যে বলে উঠবেন : অনাহারে নাহি খেদ/ বেশী খেলে বাড়ে মেদ। তাছাড়া তিনি এটাও বুঝতে পারলেন, যে এই ছেলেগুলির থেকে খুব বেশী টাকা বের করা,আর দাউদ ইব্রাহিমকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রায় একই লেভেলের উদ্যোগ। অতএব যথোচিত কাঠিন্যে শুধু একজনের ফাইনের টাকা অর্থাৎ একশো পঁচিশ নিয়েই তিনি আমাদের রেহাই দিলেন। সবাই মনের মধ্যে অল্পবিস্তর মেঘ নিয়ে স্টেশন ছাড়লো। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেটা কেটে যেতে অবশ্য বেশী সময় লাগলোনা। ইতিমধ্যে আমরা দুটি প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি।

এক :যাই হোক আর তাই হোক - রিক্সা কিম্বা ভ্যান চড়া চলবেনা। পুরোটাই পা গাড়ির উপর ভরসা রেখে এগোতে হবে, সে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন।

দুই : সিগারেট খাওয়ার বিলাসিতা পরিহার করো। ফিরে এসো দেশজ শিল্পে, অর্থাৎ বিড়িতে। যার কাছে যা অবশিষ্ট সিগারেট আছে খরচ হলেই আমরা "  কোন পুরাতন প্রানের টানে" গাইতে গাইতে  বিড়িতে টান দেবো।

কোন ব্র‍্যান্ডের বিড়ি সবচেয়ে সরেস,সেই নিয়ে উচ্চাঙ্গের আলোচনা হতে হতে ( এই ব্যাপারে দু একজনকে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ দেখা গেলো,মানে আন্তর্জাতিক বিড়ি সম্মেলনে তারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেই পারে) কখন যে ফ্ল্যাটের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছি খেয়ালই নেই। এখন থেকে আমরা একেকটি আদর্শ ছাত্রের প্রতিমুখ। প্রথমেই একটি বাওয়ালের ঝাপ্টা কাটিয়ে উঠে আমরা তখন আশা করছি যে সামনে শুধুই বিশুদ্ধ ফুর্তির দিন।

 কিন্ত তখন কি জানতাম, যে কত অন্ধকার এবং আলো অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য?



গুরুদেবের দেশে আমাদের পরবর্তী কীর্তিকলাপ বলবার আগে এটা জেনে নেওয়া ভাল,যে এত্তগুলো ছেলের থাকার ঠাঁই কি ভাবে হয়েছিলো।

আগেই বলেছি, বাবা প্রান্তিকের কাছে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। বেঙ্গল পিয়ারলেসের করা " সোনার তরী " নামের আবাসনের প্রান্তদেশে এক বেডরুমের তিনতলা। পজিশন দুর্দান্ত, কারন সামনেই আবাসনের পাঁচীল,তার ওপারে লালমাটি চিরে চলে গেছে একটি জলধারা। সেখানে ছেঁড়াখোঁড়া জঙ্গল। রাখাল গরু, ছাগল চরাতে আসে। খালের ওপারে সীমান্তপল্লীর ছায়াঢাকা গ্রাম। ছাদে উঠলে বাঁদিকে তাকালে প্রাচীন রেলব্রীজ,যেখান দিয়ে ট্রেন যায় হাতছানি দিয়ে। ডানদিকে তাকালে সরু পীচ রাস্তা বাঁক নিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। ওই রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই সোনাঝুরির জঙ্গল,অর্থাৎ খোয়াইয়ের ধার।

এই কাব্যিক পরিবেশের মধ্যে সাত সাতটি খোক্কসের উদয় হওয়ার পরে যা হবার তাই হয়েছে। দুপুরবেলা কাছেই একটা খাবার জায়গায় একপেট করে গেলার পর সেই রেস্টুরেন্টের লোকেরা তালাচাবি লাগিয়ে চলে গেছে। শান্ত নিস্তব্ধ আবাসনে কাওতালি আর হররার চোটে লোকাল কাক শালিকেরা কেটে পড়েছে।এবং কোন ফ্ল্যাটের কোন তলায় কি ধরনের ললনা বিরাজ করছেন, তৈরি হয়ে গেছে সেই ম্যাপ।

যাই হোক, যে প্রসঙ্গে এত কথার ত্যানা প্যাঁচানো। সাতটা দামড়া ছেলের একটা  ছোট্ট ফ্ল্যাটের মধ্যে আরামসে থাকার রহস্য এবার খোলসা করি।

হিসাবটা খুব সোজা।

১) ঘরে মিনিমাম সময়ের উপস্থিতি। সারাদিন বাইরে টো টো করে ঘুরে হাল্লাত হয়ে বাড়িতে এসে,আবার দু ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে যাওয়া। শীতের শান্তিনিকেতনে চার দেওয়ালের মধ্যে যে থাকে তার চেয়ে দুর্ভাগা কেউ হতেই পারেনা। আমরা তেমন নই,তাই হরবখত ফ্ল্যাটে গরুর হাটের হট্টগোলও নেই।

২) শোয়ার জন্য বারোয়ারি বিছানা।

একটা লম্বালম্বি গদি। তার ওপর পরপর বালিশ। ধুমশো একটা কম্বল। শুয়ে পড়ো এবার। কার বালিশ কোন মাথায়,কার ঠ্যাঙ কোনদিকে ,সব গুলিয়ে একাকার। এভাবেই জড়াপুটলি করে খিকখিক খৌ খৌ করে রাত কাবার হয়ে যেতো।এখন তিন চার বা পাঁচতারা হোটেলের বাসিন্দাদের সেইসব যৌথশয়ন মনে আছে কিনা,কে জানে?

আমাদের এই অভিযানের দ্বিতীয় কিস্তিতে নায়ক যদি কেউ থেকে থাকে, তো বান্টিসোনা ওরফে সুমিত। সেই গল্পটাই বলবো এবারে।

 কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরার কারনে সকলেই কম বেশী ক্লান্ত সেদিন। দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে একে একে লম্বা হওয়া গেলো ফরাসের ওপর। একটু খানি গড়িয়ে নিয়ে চরতে বেরোনো হবে। বাবা মা বেডরুমে আছেন,আমরা সব বাইরের হলঘরে অধিষ্ঠিত। আমাদের মধ্যে দু তিনজন ভালোমতো সিগারেট খোর হয়ে উঠেছে ফার্স্ট ইয়ারেই,সুতরাং তারা শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে সিগারেটে সুখটান দিয়ে চাদরের তলায় ঢুকেছে।

শীতের বেলা দেখতে দেখতে ঢলে পড়ে। সেদিন পরিকল্পনা ছিলো খোয়াইয়ের হাটে যাওয়ার। সেইমতো আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়েছি। চাদরের তলায় সিগারেটের প্যাকেট লুকানো আছে। বাবা এক্ষুনি বেরোবেন ঘর থেকে। তাই সব ধামাচাপা দিয়ে ভালোমানুষের মতো সবাই ফরাসের উপরে বসে। মধ্যমনি হয়ে বান্টি। বাবা বেরোলেন। আমাদের পরিকল্পনা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম। মৈনাক তখনো নাক ডাকছিলো। লোকজনের গলার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙবো ভাঙবো অবস্থায় আসায়, সে একটা " ঘোঁত " আওয়াজ করে পাশ ফিরলো,সঙ্গে চাদরটাও নিজের গায়ের ওপর জড়িয়ে নিলো অক্লেশে। আমাদের যাবতীয় গোপনীয়তা উন্মুক্ত করে সিল্ক কাটের প্যাকেটটা জ্বলজ্বল করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। ঠিক বান্টির সামনে। বাবা সেদিকে তাকালেন। আমরা সেদিকে তাকালাম। বান্টি এক গাল হাসি নিয়ে তাকালোনা। এইজন্যেই ওকে বান্টিসোনা বলে ডাকা হোত। বাবা হাসলেন। বেরিয়ে গেলেন। আমরাও হাসিতে ফেটে পড়লাম। বান্টি এবারে সেদিকে তাকালো। ওর হাসি নিভে গেলো।

কিন্ত এতেই যদি বান্টির ভোগান্তি শেষ হতো, তাহলে আমি ছেলেটাকে এ পর্বের নায়ক করতাম না।

কিছুক্ষন পর। আমরা বেরিয়ে পড়েছি হাটের উদ্দেশ্যে। ফ্ল্যাট থেকে হাট চত্বরে পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট কুড়ি মতো। পা গাড়ি চলছে বনবন। বেলা ঢলে পড়েছে, আর শিরশিরে একটা হাওয়া ভেসে আসছে খালের উপর দিয়ে। আমি,সন্দীপ,মৈনাক এবং সৌম্য ধোঁয়ার উত্তাপে সেই ঠান্ডাকে সরিয়ে দিচ্ছি। বান্টি খাবেনা। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন,অর্থাৎ দলে এতগুলো ফুঁকো থাকা সত্বেও সে কেস খেলো কেন, এই অভিমানে " দাম দিয়ে যন্ত্রনা" কে সে দূরে সরিয়ে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রাম্য চৌরাস্তায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। এই মোড়ের বাঁদিকে দশ মিনিট হাঁটলে আশ্রম,ডানদিকে গোয়ালপাড়া গ্রাম, সোজা হাঁটলেই সোনাঝুরির জঙ্গল তথা খোয়াইয়ের হাট। অনেক সাধ্য সাধনার পরে বান্টি রাজি হলো সিগারেটে চুম্বন দিতে। শীত আরো জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে হাতে সিগারেট না থাকলে ঠান্ডা কাটবে কি করে?

আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের ফোঁকা শেষ।  এখন শুধু বান্টির মুখে ধোঁয়া। সুখটান। প্যাঁক প্যাঁক শব্দে রিক্সার ঝাঁক আসছে যাচ্ছে। হাটুরে লোকেরা ঘোরাঘুরি করছে। ছাগল ছানা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে,পেছনে ন্যাংটো খোকা ততোধিক লাফাচ্ছে। রাস্তার ধারে দোকানে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। ডিমভাজার গন্ধ। বান্টির মেজাজ শরীফ। এখান থেকেই আমরা মেলায় যাবো। সেখানে কি কি হতে পারে আর না পারে সেই নিয়ে সবাই উত্তেজিত। দূর থেকে একটা রিক্সা আসছে। বান্টির মুখে আবার সেই ভুবনভোলানো হাসি ফিরে এসেছে। রিক্সা আরো কাছে চলে এসেছে। বান্টির মুখে সিগারেটের কমলা সুখ। রিক্সার উপরে বাবা।

বাবুরা এবং বিবিরা - এইবারে ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে আস্তে আস্তে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপার স্যাপার উঁকি মারতে শুরু করবে । সেই জন্যআগেই "U/A" মার্কা বোর্ড টাঙিয়ে দিলাম। একটু বুঝেশুনে দরজা খুলবেন।

সকাল। শীত। কুয়াশা। শিশির।

বাবা মা ভোরের ট্রেনে কলকাতার দিকে ফিরতি পথ ধরেছেন। কোনক্রমে তাদের দরজা খুলে দিয়ে আমি আবার ফরাসের উপর লম্বা হয়েছি। চোখে ঘুম নেমেছে সাড়ে তিনটের পর।   আয়ায়ায়াহ..ধুত্তেরি!!! হতভাগা শান্তনুর দামড়া লাশটাকে পাশবালিশ ভেবে জড়াতে যাচ্ছিলাম। সে ঘুমের মধ্যেই একটা কাঁচা ছাড়লো। সারারাত হ্যা হ্যা করে দাঁত কেলিয়ে এখন ব্যাটা নাক ডাকাচ্ছে। কিক্কেলো রে বাবা। প্রায় মমি পোজে খানিকক্ষন শোয়ার চেষ্টা করলাম। ধুসসসস।

কটা বাজে এখন? ঘড়ি জানালার তাকে। সৌম্যকে খোঁচা দেওয়া যাক একটা। শালা মরে গেলো নাকি!!!

- ইরিবাবায়ায়া। কি ঠান্ডা!!! শালা এ শান্তিনিকেতন না দার্জিলিং।

বলতে বলতে সন্দীপ উঠে পড়লো। আমি এক দৌড়ে বাথরুমে।পটি পটি ভাব হচ্ছে একটা। এইসব মালেরা একবার উঠে পড়লে বাথ্রুমে যাওয়া ভোগে। ন্যাট জিয়োতে কুমীরের বাসায় ডিম থেকে বাচ্চা বেরোনো দেখেছেন কখনো? পাঁচ মিনিটের মধ্যে একে একে সবাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে এবার,ঠিক সেই স্টাইলে। প্রায় একসাথেই।  সেইসময়ে আমরা শোয়া বসা খাওয়া ঘুম প্রায় যৌথ ভাবেই পালন করতাম কিনা।

ফ্রেস হয় যখন বেরোলাম, জনতা তার মধ্যে হেবি চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। অনির্বান ভেতরের ঘরের বিছানায় আবার লম্বা হয়েছে,আর সবচেয়ে মোলায়েম বালিশটা দখল করেছে। বান্টি সেই বালিশ টানাটানি করছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সংসারী সন্দীপ গম্ভীর মুখে চায়ের জল চাপাচ্ছে। মৈনাক আর সৌম্য কালকে কেনা একটা বিড়ির প্যাকেট থেকে দু পিস বার করে তরিবত করে টানছে আর মাঝে মাঝেই জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে বলছে : শালা কি কষটা মাইরি। শান্তনু চূড়ান্তভাবে ফরাস আঁকড়ে ঘুমোচ্ছিল। সে যে কিভাবে পাঁচ পাঁচটা ডিফেন্ডারকে মারাদোনাসম  ডজ করে বাথরুমে ঢুকে পড়লো,সে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য!!! কেউ কিছু বোঝার আগেই ধাঁই করে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, আর হেঁড়ে গলায় শোনা গেল গান : আরে চাঁন্দ সিতারে ফুল অর খুসবুউউউউ...।

- শালা খুসবু বলে টানটা দিচ্ছে দ্যাখ। ছাদ টাদ ভেঙে না পড়ে। " অনির্বান ঠ্যাঙ দোলাতে দোলাতে বললো।

- ওরে, কাল বারন করেছিলাম ডিম না খেতে। খুসবু তো দরজা ভেদ করে বেরোচ্ছে এবার।" সৌম্যর ফোড়ন।

সন্দীপ " চা গুলো নে, বেবুনের দল " বলে সবেমাত্র হাঁক পেড়েছে,ঠিক এমন সময়ে...।

কোত্থেকে যেন একটা রিনিরিনি হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে না? চুড়ির রুনুঠুনু? মধুর পদসঞ্চার? 

আমরা সবাই দুদ্দাড়িয়ে জানালা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে,ঘরের দরজা খুলে দেখতে শুরু করলাম। সৌম্য আর না পেরে ছাদের দিকে চলে গেলো। আমাদের সেই বুভুক্ষু দশা দেখলে জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর গুলোও লজ্জা পেতো সেদিন। শান্তনু ততক্ষনে " হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ " গাইতে গাইতে গাইতে নিজেকে হৃতিক রোশন না হোক,রসুন অব্দি ভেবে ফেলেছে। অনির্বান তাকে তিন খিস্তি দিয়ে  বললো : কাকায়ায়ায়া। মামনিইইইইই। চুউউপ। কাকা চুপ করলো আর তিন মিনিটের মাথায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে " কই, কই শুরু করলো। "

আমরা যখন এইভাবে দাপাদাপি করছি,সন্দীপ তার শকুনের চোখ দিয়ে খুঁজে বের করলো সেই এল ডোরাডো। আমাদের ফ্ল্যাট হচ্ছে টপ ফ্লোরে। সেই ফ্ল্যাটের বেডরুমের জানালার ঠিক নীচে একটা দোলনা। সেখানেই আবির্ভূতা হয়েছেন লাল সোয়েটার গোলাপী সোয়েটার পরে দুজন পরী ( পরে আবিষ্কার করা হয়েছিলো,এই দোলনাটি একইসাথে আনন্দ আর মাথাব্যথার জোগান দিতে পারে। প্রচুর রমণীয় কমনীয়দের মেলাও যেমন দেখেছি,গাদা বাচ্চাদের চ্যাঁ ভ্যাঁও সহ্য করতে হয়েছে)। আমরা জানালা দিয়ে একে আরেকজনকে টপকে তাদের দেখার চেষ্টা করছি,দেখি অনির্বাণ আর সন্দীপ ধড়াচূড়া পরে রেডি!!!! কি ব্যাপার?

- কোথায় যাচ্ছিস ভাই? 

বান্টির সরল প্রশ্ন।

- যাইহ। মেয়ে গুলোর সাথে একটু আলাপ করে আসি। অনির্বান তুই কোনটাকে নিবি?  সন্দীপ নিরাসক্ত ভাবে বললো।

আমরা তো পুরো হুব্বা!!!  ইলেভেন টুয়েলভে স্কুল আর কোচিং এবং ফার্স্ট ইয়ার - এই হচ্ছে আমাদের মেয়ে চেনার দৌড়। নিজে থেকে যেচে কারো সাথে আলাপ করতে যাওয়া, অন্তত আমার কাছে,একটা অকল্পনীয় কেস ( সত্যি বলতে কি,আমি এখনো সেটা পারিনা। কেমন যেন জিভ শুকিয়ে যায়,হাত ঘামে আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ বের হয়। একবার একটি মেয়ে আমাকে retarded ভেবে অনেক সহানুভুতি দেখিয়ে ছিলো।)

অনির্বাণ দেঁতো হেসে বললো : কি রে, আর কেউ যাবি?

আমরা সবাই তখন বিশাল একেকজন আদর্শবাদী। " এইভাবে যেচে কারু সাথে আলাপ করিনা ", " মেয়ে গুলো হ্যাংলা ভাববে" থেকে শুরু করে বাঙলার  যুব সমাজের অবক্ষয় নিয়ে একটা কঠিন ভাষণ শুরু করা যায় কিনা ভাবছি - সন্দীপ আর অনির্বাণ  আমাদের  আঙুর ফল টক আর নিতে না পেরে " তোরা বসে বসে ছেঁড় " বলে গটমটিয়ে নীচে নেমে গেলো। আমরা আবার গ্যালারীতে ফিরে এলাম। একটু পরেই দেখি গুটি গুটি দুই মক্কেল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটা হাবভাব যেন স্বর্গের উদ্যানে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে দুটো দেবদূতের বাচ্চা। মেয়ে দুটো ওদের দেখে কিছুটা সংযত। নীচ থেকেই শুনতে পাচ্ছি সন্দীপ বললো : গুড মর্নিং। দোলনায় বসে থাকা মেয়েটা প্রত্যুত্তর দিলো।  আমরা ওপর থেকে খিক খিক করে হাসলাম।

নীচে কথাবার্তা চলছে। সন্দীপ নানা রকম বোলচাল দিচ্ছে। অনির্বানও কম যায়না। মেয়েগুলো কোন ফ্ল্যাটে উঠেছে থেকে শুরু করে বাড়িতে কে কে আছে, কোলকাতায় কোথায় থাকা হয়,কোথায় পড়া হয় ( সন্দীপ জেভিয়ার্সে পড়ে শুনে মেয়েদুটো খুবই ইম্প্রেসড। অনির্বাণও তাই জাভেরিয়ান হয়ে গেলো,যদিও সে টেকনোর পোলা)। বকবকমের মাঝে অনির্বাণ আঙুল দিয়ে আমাদের দেখালো, আমরাও হেঁ হেঁ করে হাত নাড়লাম। তারপর সন্দীপ হাল্কা করে কিছু একটা বলাতে মেয়েদুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।

-  নির্ঘাত কান ভারী করছে। মৈনাক গরগর করে বললো।

- কি বলছে বলতো? সৌম্য উত্তেজিত ভাবে একটা বিড়ি ধরিয়েছে।

- বলছে নিশ্চয় আমরা সব আবোদা ছেলেপুলে, মেয়ে দেখলে প্যান্টে হিসু করে ফেলি।

- শালা শুয়োর।

শান্তনুর খেদোক্তি।

বান্টি চিন্তিত ভাবে বললো - এসব গপ্প দিলে তো মুশকিল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে তো মেয়ে গুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতেই পারবোনা।

- ওপর থেকে এক বালতি জল ঢেলে দিলে কেমন হয়? আমার সুচিন্তিত পরামর্শ।

- হে হে, তার চেয়ে সৌম্য, তুই বরং বিড়িটা সন্দীপের টাক বরাবর...

শান্তনুর কথা শেষ হতে পেলো না,কারন সকলেই হাঁ হাঁ করে উঠেছে। এই মাগগিগন্ডার বাজারে একটা বিড়িও  বহুমূল্য। শান্তনু এ রসে বঞ্চিত, তাই এত সহজে কথাটা বলতে পেরেছে,নয়তো প্রাণে ধরে এমনটা ও করতে পারতো কি?

আমরা পরস্পর এই সমস্ত বিষাক্ত আলোচনা করছি,এমন সময় মেঘ না চাইতেই জল।

তাড়াহুড়োতে বেরিয়ে যাওয়ার কারনে ছেলেদুটো খেয়াল করেনি বাইরের টেম্পারেচার কতটা নির্মম হতে পারে। সকাল সাড়ে সাতটাতেও বাঘা শীত জাপ্টে রেখেছে শান্তিনিকেতনের সর্বাঙ্গ। এর মধ্যে সন্দীপ আবার একটু সুখী প্রাণী। ঠান্ডা গরম একটু এদিক সেদিক হলেই  কাতর হয় পড়ে। কলকাতা থেকে সে একটা বাহারী কানঢাকা টুপি নিয়ে এসেছে,আর সূর্য ডুবলেই সেটা পরে ফেলছে। এই তুরীয় মুহুর্তে আমাদের টুপি ফুপির কোন খেয়ালই থাকতো না,কিন্ত সে আবার খুব হিসেবী মানুষ, সব টিপটপ হওয়া চাই।

অতএব,

- ওইইই। আমার টুপিটা একবার দে তো।

নীচ থেকে আমাদের উদ্দেশ্য করে তার হুকুম ভেসে এলো।

সকাল সকাল পেটে কিছু পড়েনি। এইসব কান্ডের মধ্যে চা জুড়িয়ে জল। তারপর  ওই মেয়ে দুটোর কাছে আমাদের চরিত্র ফুল গ্যামাক্সিন। এর পরে টুপি!!! বারুদে যেন বিড়ি পড়লো একটা।

মৈনাক একটা ক্রূর হাসি দিলো। তারপর জানলার কাছে গিয়ে মধুক্ষরা কন্ঠে বলে উঠলো - কার টুপি রে? তোর,না তোর ভাইয়ের?

প্রথমে পাঁচ সেকেন্ডের নীরবতা। সন্দীপ চুপ। অনির্বান চুপ। মেয়েগুলো মাথা নীচু করে চুপ। একটা কাঠবেরালি সামনের সজনেগাছে ডাকাডাকি করছিলো। সেটা পর্যন্ত স্পিক্টি নট।

তারপরে হা হা হি হি খুঁ খুঁ খৌয়া খৌয়া!!

শান্তনু হাসতে হাসতে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলো।

এরপরে সন্দীপ আর অনির্বাণের বুক ভরা আশা যে ধুক করে নিভে গিয়েছিলো, সেটা আশা করি বলে দিতে হবেনা। কিছুক্ষন পরে ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ওরা আমাদের কি বলতে পারে তার জন্যও কোন প্রাইজ নেই। তবে মেয়েগুলোকে আর ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। আমার ধারনা, সেদিনই ওরা শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে।

আমাদের নিয়ে ভ্যাজরং অনেক হোল।আপাতত খানিকক্ষণ যতি। তবে সেই শুনে আপনি যে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শোবেন - সেটি কিছুতেই হতে দেবোনা।আমরা আবার ফিরে আসবো স্বমহিমায়। তবে তার আগে " সেই আমলে শান্তিনিকেতন " কেমন ছিলো, সেটা একটু বলা দরকার।

সেই আমল? সেই আমল মানে?  রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আপনারা কি co founder?
 
হেঁ হেঁ। চটছেন কেন। না মানে,এই বছর পনেরো আগের কথা।

বছর পনেরোওওওও!!! তখন ওখানে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো বুঝি?

এই দেখুন,আপনি আবার চটে যাচ্ছেন। হ্যাঁ মশাই, মাত্র পনেরো বছর আগের কথা। তবে এরই মধ্যে শান্তিনিকেতনের নানারকম ছোট বড় এদিক ওদিক যা হয়েছে, সেটা ব্যক্ত করতে বড্ড ছটফটানি লাগছে হঠাত। তাহলে শুরু করি? না না, এই দু চারটে ফারাকের পাঁচালী। বেশি সময় নেবোনা।

সেকাল এবং একালের মধ্যে প্রথম, এবং প্রধান যে ফারাকটা চোখে পড়ে,সেটা হোলো হুজুগে পাবলিকের ভীড়। এটা তখনও ছিলো। কিন্ত এত বীভৎস ছিলোনা। এই পিরীতের সাথে একমাত্র পাল্লা দিতে পারে সিগনালে রবীন্দ্রসংগীত বাদনের অত্যাচার।  বিশেষ করে দোলের সময়ে যে লেভেলের ভীড় হয়, তাতে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা যখন তখন হয় যেতে পারে। গরদের পাঞ্জাবী ফৌজ আর পৃথুলা আদি ঢাকেশ্বরী বাহিনী মহামারীর মতো পালে পালে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে দোলে, পৌষমেলায়,বা খ্রীষ্টোতসবে ওখানকার মানুষের আনাগোনা গেছে কমে। আমি নিজের চোখে দেখেছি স্থানীয় মৌলবীসাহেব কাঁচের মন্দিরের চাতালে বসে বুঁদ হয় শুনছেন ব্রহ্মোপাসনা। মেলার মাঠে ফকিরি গানের আসরে দেহতত্ত্ব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে একজন সাঁওতাল রমনী। সেইসব দৃশ্য আর দেখা যায়না।

দ্বিতীয় ফারাক দেখা গেছে নিরাপত্তায়।
নোবেল চুরি হওয়ার পর থেকে আশ্রম কতৃপক্ষ " চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে " আপ্তবাক্য বুকের মধ্যে নিয়ে চত্বরটাকে প্রায় জেলখানায় রুপান্তরিত করেছেন।  পর্যটকদের মোটামুটি ছাগল চরানোর মতো " এইখানে দাঁড়াবেন না", "ওইখানে বসবেন না", এই দিকে এক ঠ্যাঙে লাফিয়ে চলুন, ওইদিকে মাথা নীচে পা ওপরে করে থাকুন ", বলে জিনা হারাম করে দেবে। ভীড়ভাট্টার সময়ে এদের মুখচোখ দেখে মনে হয় পারলে জনতার ওপরে টিয়ার গ্যাস চার্জ করে। আপনি রিক্সা থেকে নামতে বাধ্য হবেন প্রায় মাইল খানেক দূরে। তারপর খাবি খেতে খেতে হন্টন। সঙ্গে বয়স্ক মানুষ থাকলে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য এখন হয় দাঁড়িয়েছে যে কোন প্রকারে চত্বরের মধ্যে আপনাকে ঢুকতে না দেওয়া। মানে  না রহেগা বাঁশ,না বজেগি বাঁশুরি। সেটাই তো সবচেয়ে সহজ। আর আমাদের আমলে? সাতই পৌষ সকালবেলায়, বৈতালিক শেষ হয় যাওয়ার পরে  উত্তরায়ন চত্বরে ঢোকার কোন বিধি বাঁধন থাকেনা। উদয়ন, অথবা কোনার্কে আজকাল প্রবেশ নিষেধ। অথচ আমি দিব্যি গায়ে হাওয়া দিয়ে উদয়নের এ ঘর করে বেড়িয়েছি সেদিন। এখন তা শিবের অসাধ্যি। যে অচলাতয়ন ভেঙে ফেলার ডাক দিয়েছিলেন বিশ্বকবি - সেই অযথা নিয়মের নিগড়েই তার প্রিয় শান্তিনিকেতন আজ বাঁধা পড়ে গেছে।

তৃতীয় ফারাক দেখা গেছে উন্নয়নের। প্রথমবার যে প্রান্তিক স্টেশন আমি দেখেছিলাম, সেটা ছিলো লালমাটির একটা বাঁধানো চত্বর মাত্র। এখন আপনি গেলে হাঁ হয় যাবেন। ইয়া ওয়েটিং রুম,ঝাঁ চকচকে প্ল্যাটফরম - কি নেই সেখানে। স্টেশনের পেছনে যে জংলা ডাঙা ছিলো সেখানে মাথা তুলেছে সারি সারি বিষন্ন রেল কোয়ার্টার। প্রান্তিক আজ আধুনিকা। শুধু আমার ছোটবেলার খুদে স্টেশনটা হারিয়ে গেছে। এছাড়াও এদিকে ওদিকে একশো রিসর্ট, দুশো বাড়ি উঠে এখানকার উদার আকাশকে কেমন যেন ভাগাভাগি করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। যে উদার প্রকৃতির জন্যে আমি বারবার ছুটে গেছি,সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয় যাচ্ছে চোখের সামনে। শুনেছি সোনাঝুরির লাল মাটির রাস্তাটাকেও নাকি পিচে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ওই কাঁচা পথের উপরে লাল কাদা কিম্বা ধুলো মেখে অনেক বর্ষা বসন্ত কাটিয়েছি। উন্নয়নের চাপে সেইসব এখন স্মৃতি।

উন্নয়নের দাঁত নখ কিভাবে সারল্য আর সুন্দরকে ধ্বংস করে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় শনিবারের হাট। প্রথম যখন এই হাট বসতে থাকে, আমি সেই সময় থেকেই এর বিবর্তনের সাক্ষী। শুরুর দিকে হাট বসতো প্রকৃতি বীক্ষন কেন্দ্রের ভেতর।  এই কেন্দ্রটি বস্তুত কলাভবনের ছেলেপুলেদের করা কিছু বিমূর্ত ভাস্কর্যে ঘেরা। সেখানেই শনিবার দিন জড়ো হতো নানান কিসিমের লোকজন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কাছের গ্রাম থেকে দুজন বউ নিয়ে এসেছে বেগুন, ঝিঙ্গে,লাউ। তার পাশেই এক ফ্রেঞ্চ রমনী বসে গেছেন দুর্দান্ত জিঞ্জার ব্রেড নিয়ে। তার পাশেই হয়তো আবার কলাভবনের কোন থার্ড ইয়ার ছোট ছোট পোস্টকার্ড এঁকে নিয়ে এসে হাজির। বোধকরি গুরুপল্লীর দুই গুরুপত্নী নিয়ে এসেছেন বাড়িতে তৈরি পিঠে। এক বুড়ি কয়েকটা নক্সীকাঁথা আর রঙচঙে পুঁতির মালা নিয়ে বসে গেছে। খরিদ্দার প্রায় সবাই স্থানীয় আর কয়েকজন টুরিস্ট। আড়ালে কয়েক কলসী হাঁড়িয়াও দেখা যাচ্ছে। আপনাকে আশ্রমে যেতে হবেনা। রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবেনা।বিশ্বভারতীর মূল সুর বোঝার জন্য এই হাটে আসাই যথেষ্ট। এ হচ্ছে সেই আমলের কথা। আর এখন? বিশাল বিশাল গাড়ি চেপে বাবু বিবিরা আসেন। তাদের সাথে আসে পেটমোটা বাচ্চার দল। তারা সব রোদচশমা আর বার্মুডা পরে হুমহাম করতে করতে দরাদরি করে। হাটও সরে গেছে অনেক পেছনের দিকে। সেখানে এখন হ্যান্ডিক্রাফটের পশরা যেগুলো প্রায় সবই আপনি পাবেন অন্য জায়গাতে। পার্থক্য খালি এখানে খোলা আকাশের নীচে চলছে কারবার, তাই বেশ একটা ফোকি ফোকি ভাব। পারফর্মিং বাউলরা চলে আসেন সাইকেল নিয়ে। দু একটা চেনা গান করেন। প্যালা পড়ে। বাবুরা ভাবেন, বা: শান্তিনিকেতনের কি এথনিক আবহাওয়া!!  এই গোলমালের মধ্যে সেই খ্যাপা বৈরাগী শুধু অদৃশ্য হয়েছে, যার কাছে আমি অসাধারন কিছু গান শুনেছিলাম। হ্যাঁ, ঠিক এই শিমুল গাছের তলায়।

বইমেলায় টিকিট তুলে দিয়ে যে গরুর হাট তৈরি হয়েছে, শান্তিনিকেতনের আজ সেই অবস্থা। তার জলবায়ুর মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন খ্যাপামি ছিলো,তার জায়গা করে নিয়েছে শহুরে বেহুদা কোলাহল। আমরা যে শান্তিনিকেতনে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছি,তার মধ্যে তখনও কিছুটা বেখেয়ালীপনা ছিলো। তাই হয়তো খুচরো খাচরা পাগলামী গুলো করতে পেরেছিলাম। তার কিছু ক্ষনস্থায়ী,কিছু আবার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখনো জীবন্ত।

এই পর্বটি লেখা শেষ করে আপাতত আমার বকবকমে ইতি টানবো। বন্ধুবান্ধবের কীর্তিকলাপ লিখতে বসলে খাতা বন্ধ করা সত্যিই  মুশকিল। কিন্ত সময়াভাবে নিয়মিত বসাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয় দাঁড়াচ্ছে। একটা দায়ভার চেপে বসছে সেই কারনে। আপাতত সেই দায় কাঁধে নিতে আর ইচ্ছে করছেনা। যেদিন ফের মাথায় পোকা নড়েচড়ে বসবে - পেন কামড়ে আবার শুরু করা যাবেখন।

শান্তিনিকেতনে আমাদের নষ্টামির শেষভাগ নানা রঙে রঙীন। তার একদিকে যদি ভৌতিক গা ছমছম, তো অন্যদিকে রোমান্সের গোলাপী প্রজাপতি। কখনো ফুটে বেরোচ্ছে স্বেচ্ছাচারের কালোহাত, আবার অন্যদিকে সাম্যবাদী হাউমাউ। কোনটার দিকে বেশী ফোকাস মারবো সেটাই হলো আসল হার্ডল।

বরং আমাদের " দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান " কাণ্ডকারখানা গুলোই আগে বলা যাক।

হয়তো মনে আছে যে শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই আমার বন্ধুরা ভারতীয় রেলের তহবিলে একশো পঁচিশ টাকা জমা করেছিলেন। স্বেচ্ছায় নয় অবশ্য, করেছিলেন ফাইন হিসেবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হয়েছিলো বলা যায়না,তবে বন্ধুরা প্রায় সর্বহারার পর্যায়ে নেমে এসেছিলেন। এই দুর্ঘটনার কারনে নানাভাবে বাজেট কাটছাঁট করার প্রয়োজন হয় পড়ে,নয়তো সেই শীতকালটা বোলপুরেই থেকে গিয়ে একশো দিনের কাজ টাজে নাম লেখানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকতোনা। বাজেট ছাঁটাইয়ের ফলে প্রথম কোপ পড়ে নেশার দ্রব্যে,অর্থাৎ সিগারেটের হাইওয়ে ছেড়ে বিড়ির কাঁচা রাস্তা ধরতে হয়। দ্বিতীয় কোপ পড়ে পরিবহনে। শান্তিনিকেতনের রাঙা ধুলোয় আমাদের পা বারবার লাঞ্ছিত হতে থাকে,কিন্ত আমরা সাচ্চা সংযম দেখিয়ে রিক্সা বা ভ্যান রিক্সার আকুল আহবান থেকে নিজেদের বিরত রাখি। সেই পাঁচদিনে যে দূরত্ব আমরা চষেছিলাম, তাতে সম্মিলিত ভাবে হয়তো পায়ে হেঁটে কলকাতাই পৌঁছে যাওয়া যেতো। এই ম্যারাথনের ফলে আমাদের অবশ্য খুব একটা হেলদোল দেখা যেতোনা,কারন সামনে যদি লক্ষ্যবস্তু থাকে কোন অষ্টাদশী তো আমরা জাহান্নমেও পাড়ি জমাতে পারতাম তখন। আজ্ঞে হ্যাঁ,একথা অস্বীকার করে আর লাভ নেই,যে মহান কবির কীর্তিস্থলে আমরা কিছু উচ্চ চিন্তা নিয়ে যাইনি,গেছিলাম মূলত মেয়েবাজী করতে। সেটা করতে করতেই কখন যে বিকেল ঢলে সন্ধে হয় রাত্তির গড়াতো, খেয়ালই থাকতোনা। বিকেল চারটে সাড়ে চারটের মধ্যে যথোচিত মাঞ্জা মেরে বেরিয়ে পরা হতো। আমাদের বাড়ি থেকে মেলার মাঠ পায়ে দম থাকলে আধা ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। জনা সাতেক উঠতি জোয়ান পাশাপাশি কলার উঁচিয়ে হাটতাম। তখন " কাঁটে " সিনেমাটা সদ্য রিলিজ করেছে। সেই খলনায়ক গোষ্ঠীর মতো ভাও খেতে খেতে কি যাওয়া আমাদের, সে যদি তোমরা দেখতে!!! এইভাবে মেলা চত্বরে ঢুকে হ্যান্ডিক্রাফটের স্টল থেকে শুরু করে সিউড়ির আচার পেরিয়ে " হরেক চিজ পাঁচ টাকা"র দিকে কান না দিয়ে আমরা বাউল ফকিরের আখড়ায় গিয়ে বসতাম।
 স্টেজে তখন একটা লোক তার সপ্তক ছাড়িয়ে ভাবে বিভোর। তার সাথে সঙ্গত করছে যে বাঁশুরিয়া, সেও আগুন ছোটাচ্ছে। হবে নাইবা কেন? মঞ্চের পেছনে তখন নীল নীল ধোঁয়ায় তাজ্জিম মাজ্জিম অবস্থা।এই সমস্ত কান্ড করে যখন পেটের ভিতরে চোঁ চোঁ করতো,আর মেয়েদের ঠ্যাঙের দিকে তাকিয়ে  চিকেন তন্দুরীর লেগ পিস মনে পড়তো, আমরা রণে ভঙ্গ দিতাম। খাওয়া দাওয়াতেও একশো পঁচিশ টাকা তার কালো হাত বাড়িয়ে দিতো। আমরা কঠিন মুখ করে রুটি আর ঝালঝাল ডিমের তরকারী খেতে বসতাম এক প্রায়ান্ধকার ঝুপড়িতে। ওই চত্বরে সেটাই সবচেয়ে সস্তা ঠেক। আমাদের পাশে বসে ঝিমোতো ডেইলি বাংলু খাওয়া একটা মাল। পায়ের নীচে একটা লুব্ধ ছাগল ঘুরঘুর করতো। দূরে মেলার হট্টগোল আর আলো ঝুলে থাকতো জমাটি ঠান্ডায়। দুপুরের খাওয়া আরো শস্তায় করা যেতো বিশ্বভারতী ক্যান্টিনে। সেখানে দশ টাকায় রুটি এবং তড়কা পাওয়া যেতো। ক্ষিদের মুখে সবই উড়ে যেতো বটে, তবে এ কথাটা অস্বীকার করে উপায় নেই যে তড়কায় নুনের মাত্রাটা কিঞ্চিৎ বেশি হত আর কি। সত্যি বলতে কি আমাদের চাপাচাপিতে বান্টিসোনা কিচেনে প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিলো এটা জিজ্ঞেস করতে, যে রান্নার ঠাকুর কি তড়কাতে নুন দিয়েছে না নুনে তড়কা দিয়েছে। ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত আর অতোদুর গড়ায়নি,নইলে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ হয়তো অতটা শান্ত আর থাকতোনা। বাড়ি ফিরে দুটি জিনিস করা হতো। এক বালতি জল গরম করে তার মধ্যে পালা করে পা ডোবানো হতো। সেকি অনির্বচনীয় সুখ, আহা আহা!! কোথায় লাগে পাঁচতারা হোটেলের স্পা। সারা সন্ধে হেঁটে এসে সেই আদরের ছোঁয়া নিয়ে আমরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতাম। তারপরে অনির্বাণ মুখে একটা ভিলেনি হাসি টেনে বলতো : বেশ। এবার শুরু করা যাক।

আমরা ফরাসের উপরে গম্ভীর ভাবে বসতাম। একে অপরের মুখোমুখি। যাকে বলে রহস্যের খাসমহল।

 সৌম্য ( মৈনাকের দিকে তাকিয়ে) :

- বের কর।

মৈনাক তার জ্যাকেট থেকে একটা কিছু বের করে মাঝখানে রেখে হিসহিসে গলায়  :

- এবার তোর পালা।

সৌম্য তার টুপির ভেতর থেকে বের করলো বের করে আনলো আরো মারাত্মক জিনিস। মৈনাকের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

আমি সন্দীপকে বললাম :

-  ভালোয় ভালোয় এবার সামনে রাখ যা এনেছিস।

সন্দীপ আমার থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে প্যান্টের গোপন পকেট থেকে যা বের করে আনলো তাতে ঘরের মধ্যে খেলে গেলো  হাল্কা শিহরন।

বান্টি মাথা নীচু করে বসে আছে। সে কিছুই আনেনি। তার ভাগ্যে ঝুলছে হয় কুমীর দিয়ে খাওয়ানো,নয় পাহাড় থেকে ধাক্কা। তাকে অবশ্য বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।

এবারে অনির্বাণ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একেবারে পেশাদারী দক্ষতায় যা আমাদের সামনে রাখলো, তাতে শান্তনু আর থাকতে না পেরে হাততালি দিয়ে উঠলো : উফহহহহ গুরু গুরু!!!

আমরা সবাই তাকালাম সামনের দিকে। সেখানে আস্তে আস্তে ডাঁই হয় উঠছে কাঠের সিগারেট কেস ( সন্দীপ) নীল রঙের বেড়াল আঁকা চামড়ার বটুয়া ( মৈনাক) ফেঙ শুইয়ের ক্রিস্টাল গ্লোব ( আমি),  একটা  চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ ( সৌম্য), পাঁপড়ের প্যাকেট ( শান্তনু) আর ইয়াব্বড় একটা টেডি বিয়ার ( অনির্বাণ)। 

না:। এর কোনটাই গাঁটের কড়ি ফেলে কেনা নয়। প্রত্যেকটি বস্তু ঝাঁপা। সাহেবী ভাষায় একেই বলে shop lifting। মেলাতে ঘোরার এই আমাদের আরেকটি কারন।

কেন করতাম এরকম? অভাবে স্বভাব নষ্ট? Anti establishment আন্দোলন? গণ ক্লেপ্টোম্যানিয়া? Adventure? এখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করলে এর ঠিকঠাক উত্তর পাইনা। হয়তো এর কোন একটা কারন নেই, প্রত্যেকটাই একটু একটু করে মিশে আছে একে অন্যের সাথে। আমি যে কারনে ক্রিস্টাল গ্লোবটা ঝেঁপেছিলাম,তার কারন ভারী অদ্ভুত। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় বাস্তু এবং ফেং সুই হঠাত পূব দিগন্তে উদিত হয় হুড়মুড় করে ঘাড়ে এসে পড়ে। ঈশান কোনে কাচের ব্যাঙ রাখবেন, না কমোডের উপর জেড পাথরের খরগোস সেই নিয়ে টিভিতে চুলচেরা বিচার করা হতো। আমার এই সব বুজরুকি অসহ্য লাগতো মানে জাস্ট নিতে পারতাম না।ধারনের আঙটি, বেড়াল কাটা, বিপত্তারন মাদুলি, মন্দিরে মানত ফানত শুনলে চিরকাল আমি সেই স্থান এবং সেই লোকের সাহচর্য এড়িয়ে এসেছি। ফেং সুইয়ের উপর আমার আক্রমণ হলো সেই কারনে। আমাদের মধ্যে অন্য কেউ আবার হয়তো নিতো বান্ধবীকে ঝাক্কাস উপহার দেবে বলে। নিছক মজা করার জন্যও যে করা হতোনা, তা বলা যাবেনা। আবার কেউ অতিরিক্ত দামে জিনিস বিক্রি করলে তাকে সহবত শেখানো হতো এইভাবে। এই ঝাঁপা পর্বের, বলাই বাহুল্য,শুরু বা শেষ কোনটাই পৌষমেলায় নয়। তবে হ্যাঁ,একটা জিনিস মাথায় রাখা হতো। এমন কোন জায়গা থেকে ঝাঁপা হতোনা যেখানে দোকানদার নিতান্তই গরীব। অর্থাৎ মেলাতে মাটির উপর বসে যেসব শিল্পী ডোকরার জিনিস বিক্রি করতো,তারা হাঁড়িয়ার নেশায় টঙ হয়ে থাকলেও আমরা সেখানে যেতাম না। শুধু মাত্র বড় দোকানগুলিকেই টার্গেট করা হতো,যাদের পসরার সমুদ্র থেকে দু আঁজলা নিলে খুব একটা কিছু যায় আসবেনা আর কি। অত:পর যার যেমন দরকার সে অদলবদল করে নিতো,নয়তো নিজের জন্যই হয়তো রেখে দিলো। যেমন সৌম্য নিলো সন্দীপের সিগারেট কেস,ওর বাবাকে দেবে। সন্দীপ পেলো চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ তার মায়ের জন্য। ওদিকে অনির্বাণ নিজের কাছেই টেডি বিয়ারটা রাখলো,নাকি প্রেমিকাকে দেবে। ( অমন ধামড়া মাল ব্যাটা হাতসাফাই করলো কি করে সে এক রহস্য!!)। শান্তনু জাতির উদ্দেশ্যে ( মানে আমাদের উদ্দেশ্যে) পাঁপড়ের প্যাকেট দান করলো, আর বদলে পেলো আমার ক্রিস্টাল গ্লোব,কারন ওটা নিয়ে আমি কিই বা করুম? এই হচ্ছে কেস।

এটুকু বলার পর আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যারা এই লেখাটি পড়ছে তাদের চোখে আমরা একাধারে চার্লস শোভরাজ থেকে শুরু করে দাউদ ইব্রাহিম হয়ে হয়তো বা বিজয় মাল্যের মতো কৃতকর্মা হয় উঠেছি।  হয়তো তারা আমাদের সাথে  সম্পর্কই রাখবেন না। তাদের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে বোধহয় বাটি চামচ গুনে টুনে রাখবেন।পুলিশে হুলিয়া বেরোলেই বা আটকাচ্ছে কে? তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি মোটামুটি কলেজে থাকতে থাকতেই এই কর্মকান্ডে আমরা ইতি টানি। এসব আর তখন মজা দিচ্ছিলো না। মন তখন খুঁজে পাচ্ছিলো অন্যতর উষ্ণতা।

শান্তিনিকেতন বাসের এক পর্যায়ে এসে হঠাত আমরা ঠিক করলাম যে প্ল্যানচেট করবো। এই আইডিয়াটা আসার পেছনে অবশ্য একটা কারন আছে। বা বলা যেতে পারে পটভূমিকা।

 পৌষমেলা থেকে ফিরতি পথে, আমাদের কমপ্লেক্স আর শ্যামবাটির মোড়ের মধ্যে ছিলো একটা নির্জন গোছের পথ। শ্যামবাটির মোড় হচ্ছে সেই চৌরাস্তা যার একদিকে হাঁটলে আপনি পৌঁছবেন আশ্রমে, আরেকদিকে গেলে পড়বেন খোয়াইতে। সামনে সোজা গেলে গোয়ালপাড়া হয়ে রাস্তা মিশবে সিউড়ি যাওয়ার পাকা সড়কে আর চার নং রাস্তাটি শেষ হবে প্রান্তিক স্টেশনে।  প্রান্তিক স্টেশনের একটু আগেই সোনার তরী কমপ্লেক্স। এই রাস্তাটাই রাত্তিরে হয় পড়তো নি:ঝুম। রাস্তার ডান হাতে সমান্তরালে বয়ে চলা ময়ুরাক্ষী খালের থেকে উঠে আসতো কুয়াশা। ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্টের সাথে জোনাকীদের ব্যালে দেখা যেতো। অপর পাড়ের ঝুপসি জঙ্গল ভেদ করে সীমান্তপল্লীর কুঁড়েঘরের দু একটা টিমটিমে আলো ছাড়া ছিল অখন্ড অন্ধকার।শুক্লপক্ষ হলে আকাশ দিয়ে শনশন করে উড়ে যেতো পরিযায়ী পাখি। কৃষ্ণপক্ষে শোনা যেতো প্যাঁচার ডাক। এর সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা মিলিয়ে পরিস্থিতি দস্তুরমতো রোমাঞ্চকর করে তুলতো। এমনই এক রাতে মেলার মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে আলোচনা হচ্ছিলো সামনের এই রাস্তাটা কোন নওজোয়ান একা হেঁটে পার হতে পারবে? দেখা গেলো কেউই এ ব্যাপারে পিছপা নয়। সকলেই  আফ্রিকায় গিয়ে একা হাতে সিংহ শিকার কিম্বা বিন লাদেনকে লুডোয় হারিয়ে দেওয়ার মতো দুর্জয় ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে। তবে ইয়ে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় সাপখোপ, পোকামাকড়, ডাকাত গাঁটকাটা রয়েছে তাই...। আমরা সবাই যখন একে অন্যকে এই কথা বলে বেশ একটা সর্বদল সমন্বয় করছি হঠাত কথা নেই বার্তা নেই  সন্দীপ  খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বললো : আরে ছাড় ছাড়। সব একেকটা ভীতুর ডিম! কারো ইয়েতে ইয়ে নেই আবার বড় বড় বাতেলা? কি???? এও শুনতে হলো ? এ তো রজনীকান্তকে " Action  জানেন" জিজ্ঞেস করা!!! শারুক্ষানকে রোমান্সের বিষয়ে লেকচার দেওয়া!!! অনু মালিককে অরিজিনাল সুর করতে পরামর্শ দেওয়া!!! না:। এই অপরাধের ক্ষমা নেই। সন্দীপ বাদে আমরা সবাই দাঁত কিড়মিড় করে ঠিক করলাম এর একটা বিহিত করতে হবে।

আগেই বলেছি যে রাস্তার ওপর দিয়ে সোনার তরী যাওয়া যায় সেটা বেশ নি:ঝুম। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট আছে বটে কিন্ত বালব নিখোঁজ। এটা দেখে আপনি জটায়ুর মতো " dacoits" বলে দু:খপ্রকাশ করতে পারেন কিন্ত কিছু করার নেই। তবে হাতে টর্চ থাকলে কোন চাপ নেই,আর সামনে সোনার তরীর আলো, ডানদিকে মেলার মাঠে আলোর আভা, সব নিয়ে মোটামুটি নজর চলে। তবে শীতকালে সরু নির্জন রাস্তা তো সরু নির্জন রাস্তাই। সুতরাং আমরা মোটামুটি একসাথেই হাঁটতাম। সন্দীপের ন্যক্কারজনক কথার পরে ঠিক হল, যে ওকে কৌশলে দলছাড়া করতে হবে। দেখা যাক ব্যাটা একা এই রাস্তা দিয়ে কিভাবে যায়। সেই মতো আমরা ওকে নানাভাবে তাতাতে শুরু করলাম। মানে " তুই পারবি একা হাঁটতে " থেকে শুরু করে " নিজে শালা অন্ধকারে মায়ের হাত ধরে চলিস " জাতীয় অপমান। এইভাবে সন্দীপের পৌরুষে ক্রমাগত ঘা দিতে দিতে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হলো। কয়েকটা কাঁচা খিস্তি র অলংকারে আমাদের ধন্য করে সে গটগট করে একাই হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। আমরাও ততোধিক আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। এইভাবে পাটিগণিতের নিয়মে আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। একটু পরেই সন্দীপের বাদামী জ্যাকেট আর দেখা গেলোনা আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর ভেসে এলো : তোরা কোথায়ায়ায়ায়।

যীশুখ্রীষ্ট বা বুদ্ধদেব দয়ার অবতার হলে কি হবে,তাদেরও কিশোরবেলা ছিলো। কেউ তো আর খোকা বয়েস থেকে দুম করে দামড়া হতে পারেনা। আর আমি হলপ করে বলতে পারি সেই লেভেলের কেউ আজ আমাদের মধ্যে থাকলেও এই ডাকে সাড়া দিতেন না। কারন দেশে দেশে যুগে যুগে আঠারো বছরের ছেলেপুলেদের কেউ এই চরম খিল্লির সুযোগ ছাড়ে না। যারা ছাড়ে তাদের ডাক্তার দেখানো উচিৎ। সুতরাং আমরা চুপ করে থাকলাম। সন্দীপ আবার ডাকলো। এবারে " ওরেএএএ" বলে হাহাকার। আমরা তবুও চুপ। তৃতীয়বার চরাচর ভেদ করে সন্দীপের যেই : শালা শুয়োরের..." শুরু হয়েছে,ঝপাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। সোনার তরী ব্ল্যাক আউট,মেলার মাঠের আলো ব্ল্যাক আউট, পেছনে শ্যামবাটির মোড়ে শ্যাম বাটি বা মোড় - কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। সেই ঘনান্ধকার পরিবেশ আরো জমাটি করে "ক্র‍্যাও, ক্র‍্যাও" আওয়াজে মাথার ওপর দিয়ে একটা রাতচরা পাখি উড়ে গেলো। আমরা একটু ঘাবড়ে গেলেও একসাথে আছি বলে মোটামুটি সামলে নিলাম। কিন্ত সন্দীপ? তার কি হলো?  কোন সাড়াশব্দ নেই কেন? আমরা মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে পড়িমরি করে দৌড়লাম। কিন্ত সে কোথায়? রাস্তার উপরে তো নেই। খালের দিকে নেমে গেলো নাকি অন্ধকারে? হয়তো রাস্তার বাঁক বুঝতে না পেরে সোজা এগিয়ে গেছে সামনের বনবাদাড়ের দিকে। কিন্ত আমাদের সমস্বর হাঁকডাক শুনেও তার কোন পাত্তা নেই কেন? হঠাত রাস্তার বাঁদিকে নজর গেলো। সেখানে কিছু জঙ্গুলে গাছ আর আগাছা মিলে বেশ একটা ঘেরাটোপ তৈরি করেছে। তার ভেতর থেকে কেমন খচমচ আওয়াজ ভেসে আসছে না? ওরে বাবা!! কেয়ারটেকারের কাছে শুনেছিলাম ধারেকাছে নাকি একটা খ্যাপা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে কি...। ঝোপের পেছন থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। আমরা যে যা পারলাম ইঁট বা গাছের ডাল বাগিয়ে ধরলাম। সেই কড়া ঠান্ডার মধ্যেও কপালে বিনবিনে ঘাম দেখা দিলো।ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সোনার তরীর পেছন থেকে উঁকি মারলো শুক্লপক্ষের ফুটফুটে চাঁদ। আর আমরা দেখলাম... ও হরি!!! এ যে হতভাগা সন্দীপ। মুখ চোখের অবস্থা শোচনীয়। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। কেস কি?
আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য তার মধ্যে বিশেষ কোন হেলদোল দেখা গেলনা। সবার দিকে একবার কটমট করে আবার সামনের দিকে হাঁটা দিলো সে।

সোনার তরীতে পৌঁছলাম। চারিদিকে অখন্ড লোডশেডিং। খাওয়াদাওয়ার পাট আগেই চুকিয়ে দিয়েছিলাম,তাই আলোর বিশেষ প্রয়োজন ছিলোনা। জামাকাপড় খুলে হিসু করে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লেই হয়। কিন্ত আমাদের মাথায় তখন খেলছে অন্যকিছু। শীতের রাত।লোডশেডিং। চারিদিক চুপচাপ। এ কিসের আদর্শ পরিবেশ? বরাবরের মতো এবারও অনির্বাণ প্রকাশ করলো সবার মনোবাসনা।

- চল। প্ল্যানচেট করা যাক।

বাস্তবিক মনেই হচ্ছিলো যে আজকের নির্জনতা কেমন অপার্থিব গোছের। লোডশেডিং হওয়া এমন কিছু নতুন ব্যপার তো নয়। কিন্ত আজ যেন সবকিছু বড্ড বেশি থম মেরে আছে। যেন কেউ  বা কারা চাইছে একটা যোগাযোগ হোক। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। তারপর আমি প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো ড্রয়ার থেকে বের করে আনলাম একটা মোমবাতি।ঘরের মাঝামাঝি একটা মোড়া টেনে নিয়ে এসে তার ওপরে সেটাকে স্থাপন করা হলো। সবাই বসলাম গোল হয়ে। সৌম্য দেশলাই জ্বালিয়ে প্রজ্জ্বলিত করলো মোমের শিখা। অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছটা অতিকায় ছায়া থরথরিয়ে কেঁপে বেড়াতে লাগল। সাত নাম্বার ছায়াটির মালিক অবশ্য ঘরে ঢুকেই জুতো মোজা খুলে কম্বলের তলায় সেঁধিয়েছে। দু একবার "ওরে সন্দীপ" ডেকেও তাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া গেলোনা। বাধ্য হয়ে আমাদেরই শুরু করতে হলো ওই পারের সাথে এক অলৌকিক  যোগাযোগ।

প্রথম সমস্যা হলো কিভাবে প্ল্যানচেট শুরু করা যায়। মিডিয়াম থাকলে অবশ্য কাজটা সহজ হতে পারে,কিন্ত একজন মিডিয়াম হতে গেলে যে মানসিক গঠন দরকার ( মানে যেটুকু পড়েছি আর কি) সেটা আমাদের কারুর মধ্যে নেই। আরো একটা উপায় আছে। কোন কাপ অথবা বাটি জোগাড় করে সেটা একটা টেবিলের ওপর রেখে তারপর আহবান করা। টেবিলের উপরে হ্যা অথবা না লিখে মোটামুটি কথোপকথন চালানো যেতে পারে। অবশ্য চক দিয়ে A থেকে Z অব্দিও লেখা যায় এবং আলাপচারিতা বেশ ভালোভাবেই হয়,কিন্ত তাতে প্রচুর সময়ের অপচয় হবে। আমাদের কেমন যেন মনে হচ্ছিলো যে যা করার এক্ষুনি করতে হবে,নইলে সংযোগ করতে পারা যাবেনা আর। ঘরে টেবিলের অভাব। তাই বাসন রাখার একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে এসে তার ওপরেই একটা কাপ রাখা হলো। এইসব যোগাড়যন্ত্র করে একে অন্যের আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁইয়ে প্রস্তুতি শেষ হল।

এইবারে দ্বিতীয় সমস্যা। কাকে ডাকা হবে? কাছাকাছি প্রিয়জন কেউ?নাকি বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব? কোথাও একটা পড়েছিলাম যে অপঘাতে মৃত হলে আত্মা সহজে ধরা যায়। কিমাশ্চর্যম!!! আমি ঠিক এই কথাটা ভাবার সাথে সাথে যেন আমার চিন্তার সুতো ধরেই মৈনাক ফিসফিসিয়ে বললো : সোহমকে ডাকলে কেমন হয়?

সোহম। সোহম হালদার।আমাদের স্কুলের বন্ধু। বছর খানেক আগে দেশের বাড়ি কালনায় গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে মারা গেছে। আমাদের সবার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে তার মুখ। বন্ধুদের ডাকে সে কি না এসে পারবে?

- ওক্কে। সোহমকেই ডাকছি আমরা।

শান্তনু ঠান্ডা গলায় বললো।

অত:পর সেই মৃত্যুশীতল রাতে একটি মাত্র মোমবাতির আলোর সামনে ছটি সম্মোহিত অস্তিত্ব সোহম হালদারকে ডাকতে লাগলো,যে অনেক দুরের পথে পাড়ি জমিয়েছে। আমরা চোখ বন্ধ করে সোহমের মুখটা মনে করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। একটা গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। কেয়ারটেকার ঢোকার সময়েই বলছিলো কোথাও একটা ট্রান্সফরমার ফেটেছে তাই আলো আসতে অনেক রাত হবে। সেটা কি সত্যি? নাকি এর পেছনে অন্য কোন সংযোগ আছে। কেয়ারটেকারের মুখটা অন্ধকারে ঠিক খেয়াল করিনি। ওর গলাটা কি রকম অন্যধাঁচের লেগেছিল না? তার মানে সবই কি আগে থেকে ঠিক করা? আমরা কি চালিত হচ্ছি? এই স্ক্রিপ্ট আগে থেকেই লেখা ছিলো। শুধু...

একটা খট খট আওয়াজে চোখ  খুলতে হলো। দৃষ্টি চলে গেল কাপটার দিকে।  ওটার মধ্যে কেমন একটা স্পন্দন দেখা যাচ্ছেনা? যেন সেটা একটা ইঁদুরের মতো জীবিত কিছু।

- সোহম, তুই কি এসেছিস?

জিজ্ঞেস করলাম খুব কষ্টের সাথে। গলা শুকিয়ে কাঠ।

কাপের ঠকঠকানি আরো বাড়তে লাগলো। আমরা বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রাঙ্কের উপরে সেটা প্রায় নেচে বেড়াচ্ছে এখন।

- সোহম, সোহম তুই কি এসেছিস? তুই এসে থাকলে হ্যাঁ লেখাটার উপর কাপটাকে নিয়ে আয়।

বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কথাগুলো আমি নিজে বলছি। কোন সন্দেহ নেই যে আমাকে এখন চালিত করছে অন্য কেউ। হয়তো আমাদের সবাইকে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে কিন্ত কিছু করার নেই আর।

কাপের ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর সেটা আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো হ্যাঁ এর দিকে। কিন্ত একি? মাঝখানে রাস্তা পালটে সেটা না এর দিকে যাচ্ছে কেন? তাহলে কি সোহম আসেনি? প্ল্যানচেট করার সময়ে অনেক সময় এমন  আত্মা চলে আসে যে অবাঞ্ছিত । এটা খেয়াল ছিলোনা আমার।  সে রকম কিছু নয়তো? এবার কি হবে? বারবার চেষ্টা করলাম সরে আসতে। চেষ্টা করলাম কাপটাকে আছড়ে ভাঙতে। কিন্ত একটা ইঞ্চি নড়তে পারলাম না। বাকীরা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেন? কেন? ঠিক এই সময় দেখলাম ঘরের দেওয়ালে নতুন আরেকজনের ছায়া পড়েছে। সাত নাম্বার ছায়া। কিছু বুঝতে পারার আগেই একটা শরীর আমার পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো মোমবাতিটার উপর। সঙ্গে সঙ্গে শনশন করে হাওয়া বয়ে গেলো আর চারিদিক ঢেকে গেলো অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের ভেতরে মহা আতঙ্কে দেখতে পেলাম....।

না:। কিছুই দেখতে পাইনি। কোন ঘটনাই ঘটেনি। কোন প্ল্যানচেট করিনি আমরা। ভেবেছিলাম করবো। মোমবাতি একটা ছিল। লোডশেডিং ছিলোনা,তবে ঘর অন্ধকার করে বসার ইচ্ছে ছিলো। কিন্ত এইসব কথাবার্তা হওয়ার সময়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সন্দীপ হঠাত লাফ দিয়ে নেমে এসে আমার হাত থেকে মোমবাতিটা কেড়ে নিয়ে মটমট করে সেটা ভেঙে ফেলে জানালা দিয়ে বিসর্জন দিয়ে আবার কম্বলে গিয়ে সেঁধোয় আর আমাদের প্ল্যানচেট করার আশা সেখানেই ধুক করে নিভে যায়।

আমরা কোন প্ল্যানচেট করিনি।

কেয়ারটেকারও বদল হয়নি সেই রাতে।

সোহম হালদার বলে কেউ ছিলনা।








রাজত্বের দাম



    
- মহামান্য সম্রাটের জয় হোক।
আলো আঁধারি মন্ত্রনা কক্ষ গমগম করে উঠলো।
সম্রাট চিন্তান্বিত ভাবে বসে ছিলেন। মূল দরবার কক্ষের কাজ সেরে সামান্য কিছু আহার করেই তিনি আজ মন্ত্রনাকক্ষে চলে এসেছেন বা বলা যেতে পারে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তার মন বিক্ষুব্ধ। চিন্তা এতটাই গভীর যে মন্ত্রনাকক্ষের দরজা খুলেছে, দুজন প্রহরীর সাথে প্রধান পুরোহিত প্রবেশ করেছেন,  তিনজনের মানুষের পায়ের শব্দে কক্ষের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হয়েছে কিন্ত সম্রাট খেয়ালই করেন নি।
সেনাপতি অবশ্য আগেই লক্ষ্য করেছেন এবং বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ভারী গলার আচমকা আওয়াজে সম্রাটের হাতে ধরা গজদন্তের লাঠিটা পড়ে গেলো। মন্ত্রনাকক্ষের দেওয়ালে দেওয়ালে সেই শব্দ ধ্বনিত হয়ে বেরিয়ে গেলো  ছোট গবাক্ষপথে।  কোন কিছুতে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করতে হলে এই লাঠির মাথাটি বুড়ো আঙুল দিয়ে খোঁটা তার অভ্যাস।
সম্রাটের বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী তড়িঘড়ি লাঠিটা তুলে তাঁর হাতে শ্রদ্ধাভরে তুলে দিলো।
- আসুন, প্রধান পুরোহিত।
পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে নত হয়ে অভিবাদন জানানোর পর সম্রাটের ঈঙ্গিতে একটা অসামান্য সাইপ্রাস কাঠের চেয়ারে তিনি উপবিষ্ট হলেন।
 
- মহান পক্ষীদেবতা,কুম্ভীরদেবতা আর....
সম্রাট ডান হাত তুলে পুরোহিতকে নিরস্ত করলেন।
- এইসব সম্ভাষণ আমার কাছে নিরর্থক।
পুরোহিতের ঘন ভ্রু জোড়া একত্র হয়ে এলো।
- সম্রাট,যে দেবতার আপনি স্বয়ং প্রতিভূ... "
- " এখন থাক। এই মন্ত্রনাকক্ষের মধ্যে সমস্ত বড়ো বড়ো উপাধি আউড়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়না। তাছাড়া কথাবার্তা যা বলার সব বলে আমি একটু বিশ্রামে যেতে চাই। শরীরটা ভালো লাগছেনা।
সেনাপতি শঙ্কান্বিত হয়ে বললেন : " রাজবৈদ্যকে খবর দেবো মহামান্য?
- নাহ। এ তো সেই একই অসুখ। ক্লান্তি, পিঠে বেদনা, পেটে যন্ত্রনা। গত তিন বছর ধরে চলেছে। ওষুধ খেয়ে কোন ফল হচ্ছে কি?
সেনাপতি ব্যথিত ভাবে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে রইলেন।প্রধান পুরোহিতের ঠোঁটে প্রায় অদৃশ্য একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
সম্রাটের শারীরিক দুর্বলতা অবশ্য তার বয়েসের কারনে নয়। জন্ম থেকেই তিনি অশক্ত। সম্রাট সতেরো বছরের যুবক মাত্র। কিন্ত এর মধ্যেই তাঁর  আট বছর রাজত্ব করা হয়ে গেছে।পিতার মৃত্যুর পর গোটা সাম্রাজ্যকে শক্ত হাতে বাঁধার চেষ্টা করেছেন। অবশ্যই শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় নয়। সে কাজে সাহায্য করছেন তার  এবং প্রধান সেনাপতি, যিনি এখন সিংহাসনের বাঁদিকে বসে আছেন। কিন্ত লাভের লাভ বিশেষ কিছু হয়নি। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে।এই ধ্বংসের শুরু বর্তমান সম্রাটের বাবার আমলে। ভূতপূর্ব  সম্রাট তাঁর অধিকৃত এই ভূখন্ডটিকে নিয়ে অদ্ভুত একটা খেলায় মেতেছিলেন। একটা বিদঘুটে স্বপ্নের পিছনে দৌড়ে বেড়িয়ে তিনি তার পার্শ্বচর, তার পুরোহিতকূল সর্বোপরি তার প্রজাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সাথে পেয়েছিলেন মূলত তার অসামান্য সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী রানীকে, যাকে গোটা সাম্রাজ্যের লোক চাইলেও অশ্রদ্ধা করতে পারেনা। সেই স্বপ্ন হলো, যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রবল প্রতাপ দেবতাদের সরিয়ে দিয়ে নতুন দেবতার আমদানী। তাঁর চিন্তা ছিলো, দেবতা হবে একজন। তিনিই সর্বশক্তিমান,তিনিই সর্বমঙ্গলদায়ক। সম্রাট শুধু তার বার্তাবাহক মাত্র। ভালো কথা। নিজের বিশ্বাস নিয়ে থাকলে কারো কোন আপত্তি ছিলোনা। কিন্ত তিনি প্রথমে নিজের মতবাদ প্রচার করতে লাগলেন। রাজপরিবারের সবাইকে সেই ধর্মে দীক্ষিত করলেন। পুরনো রাজধানী ছেড়ে এসে " নতুন দেবতার রাজধানী "তে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সরিয়ে আনলেন। কিন্ত সনাতন যে ধর্ম প্রজাদের বুকের মধ্যে শয়ে শয়ে বছর ধরে প্রোথিত, তা স্থানচ্যুত হলোনা। প্রজারা সেই পুরনো দেবতাদের মন্দিরেই পুজো করতে লাগল। সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। পুরনো দেবতাদের বাসস্থান একের পর এক ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হতে লাগলো। প্রাচীন পুরোহিততন্ত্র ভেঙে দেওয়া হলো। সনাতন ধর্মের প্রতি সহানুভুতি সম্পন্ন প্রত্যেকের উপর নেমে এলো ভয়ঙ্কর শাস্তির খাঁড়া। গুপ্তচরে ছেয়ে গেলো শহরগুলির গলিপথ। চৌরাস্তার মোড়ে কান্নার রোল উঠেছে,আর প্রজাদের বুক চাপড়ানির শব্দ ছাপিয়ে পুরোন দেবতার কোন মূর্তি ভাঙা হচ্ছে - এই দৃশ্য হয়ে পড়েছিলো নিত্যনৈমিত্তিক।
নতুন বিশ্বাস স্থাপন করার স্বপ্নে মশগুল সম্রাট তার সাম্রাজ্যের রাশ ঢিলে করতে লাগলেন ক্রমশ। পূর্বসীমান্তে আর দক্ষিনসীমান্তের ছোট করদ রাজ্যগুলি এই ডামাডোলের সুযোগে বিদ্রোহ ঘোষনা করলো। সেনাপতিরা সম্রাটের কাছে বারবার আর্জি জানালেন সেনা পাঠানোর জন্য। কাকস্য পরিবেদনা। সেনারা তো ধর্মস্থাপনে ব্যস্ত। এই নতুন ধর্ম আগের ধর্মের চেয়ে অনেক সিধে সরল এবং মুক্তচিন্তার অনুগামী হলেও রাজ্যশুদ্ধ প্রায় কেউ বিশ্বাসই করতে পারলোনা যে আকাশের দেবতা আর পাতালের দেবতা,  জল এবং আগুনের দেবতা কি ভাবে এক হতে পারে। ঠিক এই টালমাটাল সময়ে ভগ্নহৃদয় সম্রাট দেহ রাখলেন। পেছনে ফেলে গেলেন নতুন দেবতার বিশাল বিশাল মন্দির, দুর্বল রাজধানী,ধর্মহীন বিক্ষুব্ধ প্রজা, চরম দুর্নীতিবাজ রাজকর্মচারীর দল আর ক্রমশ ছোট হতে থাকা সাম্রাজ্য।
ঠিক এই সময়ে,মাত্র নয় বছর বয়েসে,এখনকার সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করেন। সাথে ছিলেন মামা,আর যে সেনাপতি সাম্রাজ্যের একেবারে উত্তর -পূর্বপ্রান্তে মাটি কামড়ে সাম্রাজ্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন ( আর অপৌত্তলিক সম্রাটের কাছে সাহায্য চেয়ে বিফল হয়ে তাকে ঘৃণার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন ) সেই পোড় খাওয়া যুদ্ধবিদ।
- মহামান্য সম্রাট।
প্রধান পুরোহিত উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কোমর ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে বললেন : আপনার অশেষ অনুগ্রহ, যে আমাকে আবার সনাতন দেবতাদের পূজার্চনার সুযোগ আপনি দিয়েছেন। ভুতপূর্ব সম্রাটের অভিশপ্ত রাজত্বের ফলে  যে দেবতারা বিমুখ হয়েছেন, আমি তাদের প্রসন্ন করার চেষ্টা করছি মাত্র। হয়তো দেখবেন, আমাদের পবিত্র নদীর দুই কূল আবার ভরে উঠছে শস্যে। প্রজারা আবার সম্রাটের উপর বিশ্বাস ফিরে পাচ্ছেন। সনাতন দেবতাদের কৃপাদৃষ্টি ছাড়া আমার বেঁচে থাকাও হয়তো সম্ভব হতোনা কারন আপনি জানেন যে আপনার বাবা আমার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছিলেন।
- হ্যাঁ,আর আপনি প্রচুর উপঢৌকনাদি দিয়ে  জেল থেকে অন্তর্ধান করেছিলেন। সেটাও আমরা জানি।
প্রধান সেনাপতির গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ।
- কি করবো বলুন। আমার হাতে তো আর আপনার মতো তরবারী নেই যে...।
- দেবতাদের অনুগ্রহের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন।
প্রধান পুরোহিত আর কিছু না বলাই শ্রেয় ভেবে চুপ করে থাকলেন।
প্রধান সেনাপতির দেবতা টেবতা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তিনি বোঝেন যুদ্ধকলা,চান শত্রু দেশের হাত থেকে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা। আগের দেবতা, বা বর্তমান দেবতা - সবাইকেই তিনি ওম নমো ডোম নমো করে পূজা করে এসেছেন,ভবিষ্যতেও তাই ইচ্ছে আছে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পুরোহিততন্ত্রের খুব একটা সমর্থক নন। কিন্ত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান পুরোহিতের রাজধানীতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কারন এনার হাত দিয়েই দেবতাদের পূজা সুসম্পন্ন হয়,অন্তত মানুষের তাই বিশ্বাস।
প্রধান সেনাপতি ভূতপূর্ব সম্রাটের যথেষ্ট আস্থাভাজন ছিলেন। সেই কারনে বিশাল উত্তর পূর্ব সীমান্ত রক্ষার ভার তাকেই দেওয়া হয়েছিলো। তিনি ছোটখাটো বিদ্রোহ অঙ্কুরেই বিনাশ করে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেখিয়েছিলেন। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো, সম্রাটের পাগলামী শুরু হওয়া পর্যন্ত। প্রথমদিকে কেউই এসব খেয়াল নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলোনা। সমস্যা হলো ব্যাপক ধরপাকড় আর প্রাচীন দেবতাতন্ত্রকে গায়ের জোরে হটিয়ে দেওয়ার সময়ে। রাজ্যের নিরাপত্তা বিষয়ে সম্রাট উদাসীন হয়ে গেলেন। সেনাছাউনির সৈন্যদলের বদলি আটকে থাকলো। তারা অধৈর্য হয়ে উঠলো। সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ঝামেলায় সীমান্ত প্রদেশের রাজ্যগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো একই সাথে। এই সময়ে তিনি বারবার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন সম্রাটের কাছে। সেই আবেদন শুধু বিফল হয়েছে তাই নয়,সম্রাট  সন্দেহ আর অভিযোগ ভরা একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাকে। তিনি প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সেনাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর আবেদন করেন। ফলত: তাকে রাজধানীতে ডেকে আনা হয়,এবং বন্দী করা হয়। তার সেই বন্দীদশা ঘুচেছে সম্রাট দেহ রাখবার পর,তার রানীর ছোট্ট রাজত্বকালে। মৃত সম্রাটের প্রতি ঘৃনা ছাড়া তার মনে কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। রানীমাতা মারা যাওয়ার আগে নয় বছর বয়স্ক এক বালককে তার হাতেই ছাড়তে চেয়েছিলেন। তিনি এই সম্রাটকে স্নেহও করেন যথেষ্ট। মাঝখানে বাধ সাধলেন রানীমাতার বাবা। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে রাজদরবারের পরামর্শদাতা হিসেবে থাকার কারনে নাবালকের দায়িত্ব তিনি প্রায় জোর করে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। অবশ্য পদোন্নতি হওয়ার কারনে প্রধান সেনাপতি সেই নিয়ে আর বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন নি। সেই থেকে রাজমাতার বাবা বকলমে রাজ্য চালান।
প্রধান পুরোহিতের পদে পুনরাভিষেকের পর আজকের এই অত্যন্ত গোপনীয় ও জরুরী সভায় তারও থাকার কথা ছিলো। কোন জরুরী কারনে তিনি এখন রাজধানীতে নেই। কি কারন,সেটা অবশ্য কেউ জানেনা।
- হ্যাঁ,জানি প্রধান পুরোহিত। আপনার ওপর দেবতাদের অনুগ্রহ আছে। 
সম্রাট যেন কিছুটা অন্যমনা।
- দেবতাদের উপর যে অবিচার আমরা করেছি,তার ফলেই তারা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন,এখন আস্তে আস্তে আবার তাদের আশীর্বাদ আমাদের উপর বর্ষিত হচ্ছে। তবে আমার ভূমিকাও একেবারে অবহেলা করা যায় কি? আমি সুরম্য মন্দির নির্মাণ করিয়েছি, প্রজাদের মধ্যে ঘোষনা করে তাদের সাহস যুগিয়েছি যে তারা যেন আবার পুরনো প্রথায় বিনা দ্বিধায় পূজার্চনা করতে পারে। নিজের নাম পর্যন্ত পালটিয়ে ফেলেছি এর জন্য। এগুলো কি কিছুই নয়?
- অবশ্যই সম্রাট। আপনি যথাসাধ্য করছেন। অবশ্য নাম না বদলিয়ে কোন উপায় ছিলোনা। কারন আপনার নামের সাথেই মিশে ছিলো সেই অপদেবতার উল্লেখ।
- স্বীকার করছি। কিন্ত এসব সত্বেও আজ দুশ্চিন্তা আমায় কুরে কুরে খাচ্ছে।
- সুদিন ফেরার লক্ষনগুলি কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না সম্রাট।
সম্রাট সামনের দিকে ঝুঁকে কিছু রুক্ষ কন্ঠেই বললেন - সীমান্ত সুরক্ষিত না থাকলে, বহি:শত্রুর আক্রমণে সবসময়ে শির:পীড়া থাকলে কোন সুদিনই সুদিন লাগে না পুরোহিত। যদি সেই আদি জগত ত্রাতা রাজচক্রবর্তীর হাতে তৈরি এই সাম্রাজ্য গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়,তবে শস্যপূর্ণ গোলা নিয়ে কি লাভ?
- যথার্থ।
পুরোহিত মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন।
- ঠিক এই কারনেই আজ আপনাকে ডাকা। আমার পিতামহের উপর দেবতাদের আশীর্বাদ ছিলো। আপনি ছিলেন তার যোগ্য সংবাহক। আমি চাই এই সংকট কালে আপনি বলুন যে কি প্রকারে দেবতাদের সন্তুষ্ট করা যায়।
পুরোহিত চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দু হাত প্রসারিত করলেন। কিছুক্ষন সব চুপ। প্রাসাদ চত্ত্বরের বাইরে কিছু হ্রেষাধ্বনি শোনা গেল । সম্রাট একদৃষ্টে পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রধান সেনাপতি পুরোহিতের নাটক দেখে বিরক্তিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
উদগ্রীব কিছু মুহূর্তের পর প্রধান পুরোহিত আবার চোখ খুললেন। দৃষ্টিতে বোঝা গেলো, পথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন।
- সম্রাট। মার্জনা করবেন,কিন্ত আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হচ্ছি।
- বলুন।
- পৃথিবীতে দেবতাদের সাথে সংযোগ স্থাপনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম আপনিই। অথচ দেবতারা এই ব্যাপারে কি আপনার কাছে নিশ্চুপ ছিলেন?
সম্রাট ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন - আমি যা নির্দেশ পেয়েছি,তাই তো কাজে লাগিয়েছি পুরোহিত। তারপরেও এ প্রশ্ন ওঠে কেন?
পুরোহিত মাথা নাড়লেন। ডাইনে বাঁয়ে।
- না। সব নির্দেশ বোধহয় আপনি কাজে লাগান নি।
- হেঁয়ালি না করে আসল কথাটা পাড়লে ভালো হয় না কি?
প্রধান সেনাপতি অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন এই সব কথার ফুলঝুরি শুনে।
সেই ধাতানিতে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে সরাসরি সম্রাটের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রধান পুরোহিত জিজ্ঞাসা করলেন - কিছু ধ্বংস না হলে সৃষ্টি হবে কি করে সম্রাট?
- মানে?
দক্ষিন দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পুরোহিত বজ্রকন্ঠে বললেন - ওই দিকে, যেখানে সেই ভয়ংকর অপদেবতার অভ্রংলিহ দেবালয়গুলো এখনো সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে,সেগুলোকে নিশ্চিহ্ন না করে আপনি নতুন মন্দির তৈরি করে শুধু সময়,অর্থ আর পরিশ্রম ব্যয় করেছেন সম্রাট!
সেনাপতি আবার ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও থমকে গেলেন। ঠিক তো! কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। একই রাজ্যে দু রকম দেবতার অস্তিত্ব থাকে কি করে? আর যিনি স্বয়ং দেবতার বার্তাবাহক, এই সহজ ভ্রান্তিটা কি ভাবে করতে পারেন?  চোখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে সম্রাটের দিকে তাকালেন সেনাপ্রধান।
- আ..আমি এরকম কোন নির্দেশ পাইনি।
পুরোহিত তীব্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন - আপনি দেবতাদের বার্তা পান তো, মহামান্য?
নিজের অসুস্থতা ভুলে গিয়ে সদপদাপে উঠে দাঁড়ালেন সম্রাট।
- আপনি কার সাথে কথা বলছেন সেটা ভুলে যাবেন না পুরোহিত!! আমি আপনাকে সসম্মানে ডেকে এনেছি,আবার এই মুহূর্তে ধাক্কা মারতে মারতে  বধ্যভূমিতে পাঠাতে পারি! আমার ক্ষমতার প্রতি অবিশ্বাস করেন,আপনার এতো স্পর্ধা!!!
- কে যাবে বধ্যভূমিতে?
তিনজনেই চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালেন।
উত্তেজিত বাদানুুবাদের মধ্যে কেউ খেয়ালই করেনি একজন দীর্ঘদেহী পুরুষ মন্ত্রনাকক্ষে প্রবেশ করেছেন। কোন প্রহরীর সাধ্য নেই প্রাসাদের প্রায় কোন অংশে তার গতিবিধিতে বাধা দেওয়ার। ইনিই বর্তমান সম্রাটের মাতামহ। ভূতপূর্ব তিন তিনজন শাসকের পার্শ্বচর হিসেবে তিনি রাজনীতি সম্বন্ধে একজন বিদগ্ধ হিসেবেই পরিচিত। এর সামনে কখনো কখনো সম্রাটকেও গলা নামাতে হয়।
- প্রধান পুরোহিত আজ তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন মাতামহ। আমি বাধ্য হয়েছি উত্তেজিত হতে। তাঁর মতে দেববাণী আমি শুনতে পাইনা।
- আশা করি প্রধান পুরোহিত তার বক্তব্যের সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখাতে পারবেন।
সম্রাটের ডানদিকে,একধাপ নীচে একটি গোলাপী গ্রানাইট পাথরের সুরম্য চেয়ারে বসতে বসতে শান্তকন্ঠে বললেন মাতামহ তথা সাম্রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
প্রধান পুরোহিত আবার উঠে দাঁড়ালেন।
- সম্রাটের উত্তেজনার কারন ঘটানোর জন্য আমি সহস্রবার মার্জনা চাইছি। আসলে যেটা বলতে চেয়েছি...।
- প্রধানমন্ত্রী মশায় আজকের বৈঠকের বিষয়ে অবহিত ছিলেন আশা করি।
সম্রাটের রাগ এখনো যায়নি।
- না। বার্তাবাহক যতক্ষনে আমার প্রাসাদে গেছে,আমি বিশেষ কাজে নিস্ক্রান্ত হয়ে গেছিলাম।
- যদিও আপনাকে রাস্তায় আটকাতে গেছিলো দ্রুতগামী অশ্ব।
সেনাপতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে এই বার্তা পেশ করলেন।
- ততক্ষনে আর ফেরার উপায় ছিলো না।
প্রধানমন্ত্রীর গলা ভাবলেশহীন।
- সেই কাজ কি এই বৈঠকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ?
সম্রাটের গলায় অশনি সংকেত।
- এই বৈঠকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্রাট ডান হাতের ঈঙ্গিতে পুরোহিতকে আবার শুরু করতে বললেন। যদিও তার মুখ ভ্রুকুটিকুটিল হয়ে থাকলো।
- যেটা বলতে চাইছি সম্রাট তা হোলো এই যে অনেক সময়ে দেবতারা ঈঙ্গিতে আমাদের অনেক কিছু জানান,যা আমরা বুঝতে পারিনা। হয়তো সেইরকম কিছু আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
- হতে পারে। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন দেবতারা ওই পুরনো মন্দির গুলো ধ্বংস করলে খুশি হবেন?
- নিশ্চয় মহামান্য। একথা তো আমরা সবাই বিশ্বাস করি,যে এক দেবতার আরাধনা সর্বতোভাবে বর্জনীয় হওয়া উচিত।
- হ্যাঁ। তাতে সন্দেহ নেই।
- ভবিষ্যতেও যাতে অপৌত্তলিক কোন অপদেবতার ছায়া আমাদের সাম্রাজ্যে না পড়ে সেটা নিশ্চিত করাও সম্রাটের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
- ঠিক।
- সেক্ষেত্রে ওই মন্দিরগুলি ধ্বংশ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই নরোত্তম ।
সম্রাট নিজের অজান্তেই বিচলিত হয়ে ওঠেন। হাজার হোক,দক্ষিনের ওই রাজধানীর প্রাসাদ ও মন্দির চত্বরগুলিতে তার ছেলেবেলা কেটেছে। পিতামাতার স্নেহে ঘেরা সেই স্মৃতি ধুলোয় মিশিয়ে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়।
- বেশ। আপনি যা চাইছেন,তাই হবে।
প্রধান পুরোহিত উচ্চকন্ঠে বললেন : সম্রাটের জয় হোক।
- আমি একটা কথা বলতে পারি?
প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকালো সবাই।
- আপনি কি আর কোন ক্রিয়া যোগ করতে চান?
পুরোহিত কিছুটা আশ্চর্য।
- বলছিলাম এই,যে নতুন মন্দির গড়া আর পুরনো মন্দির ভাঙা এই দুটোতে তো বিস্তর খরচ। এই ব্যয় সঙ্কোচের সময়ে সেটা খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে কি?
- কিন্ত এটা না করলে তো দেবতারা সন্তুষ্ট
হবেন না মাতামহ!
সম্রাট অধীর ভাবে বললেন।
- একটা সহজ উপায় আছে।
- বেশ,শুনি।
প্রধানমন্ত্রী হাতের ইশারায় কক্ষে উপস্থিত দুজন প্রহরীকে বাইরে যেতে বললেন। তারপর পাশের মদিরা পাত্র থেকে অল্প দ্রাক্ষারস গেলাসে নিয়ে বললেন
- আমি একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটাকে প্রাঞ্জল করতে চাই। সম্রাট বা পুরোহিতের মতো দৈববাণী শোনার ক্ষমতা আমার না থাকলেও,কিছু অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। সেই সুবাদেই বলছি :
ধরুন কারুর বাড়িতে একটি বিষবৃক্ষর চারা গজিয়েছে। এবার বাড়ির মালিক যদি সেই চারার পাতাগুলো তুলে নেয়,তাহলে কি হবে?
- আবার পাতা গজিয়ে যাবে।
সেনাপতির দ্রুত উত্তর।
- যদি পাশেই একটি সুস্বাদু ফল গাছের চারা লাগানো হয়?
- বিষবৃক্ষ সেই চারাকেও মেরে ফেলবে।
- তাহলে এর সমাধান কি?
- শিকড় শুদ্ধ গাছটা উপড়ে ফেলা।
সেনাপতি হাতের ভঙ্গি করে দেখালেন।
প্রধানমন্ত্রী চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন - এখানেও আমাদের বিষবৃক্ষটিকে শেকড় শুদ্ধ উপড়িয়ে তুলতে হবে।
সেনাপতির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
- বুঝতে পেরেছি! তার মানে যে দানব " ওপারের জীবনের" সব সুযোগ সুবিধে ভোগ করছে, তার সমাধিকেই ধ্বংস করতে হবে।
- কি বলছেন মাতামহ। উনি আপনার জামাতা!!!
সম্রাট চেঁচিয়ে উঠলেন।
- রাজত্বের নিরাপত্তার কাছে এই সম্পর্ক তুচ্ছ।
প্রধান পুরোহিত লাফিয়ে উঠলেন।
- অনবদ্য। অসামান্য। আমরা কেউ ভেবেই দেখিনি যে এত সহজ সমাধান হতে পারে।
- ঠিক। এতে টাকাও বাঁঁচবে আর দেবতার অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পাবো।
সেনাপতির কন্ঠেও প্রশংসার সুর।
সম্রাট নীরবে বসে রইলেন শুধু।
- শুধু একটা সমস্যা আছে।
প্রধানমন্ত্রী খালি গেলাসটা চেয়ারের হাতলে রাখলেন।
- কি সেটা?
- আপনি দক্ষিনদিকে যাত্রা করলেন। নির্দিষ্ট সমাধিস্থলে উপস্থিত হলেন যেখানে সেই দানব সম্রাট " ওপারের  জীবন" উপভোগ করছেন। সমাধিস্থল খুললেন। সমাধিকক্ষে ঢুকলেন। তারপর সমাধি আধারের ঢাকনা খুলে আপনার তরবারী সেই অভিশপ্ত আত্মাকে ধ্বংস করতে গিয়ে দেখলো...
সেনাপতি আর প্রধান পুরোহিত প্রায় একসাথে বলে উঠলেন - কি?
- যাকে ছিন্নভিন্ন করতে এসেছেন,সেই বেপাত্তা।
- তার মানে?
সেনাপতি হতবাক।
- মানে হচ্ছে এই, যে সমাধিস্থলে কেউ নেই। শবাধার অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই ভয়ংকর খবরটা পেয়েই আমি দক্ষিনদিকে যাত্রা করেছিলাম। প্রথমে বিশ্বাস করিনি,তাই নিজে দেখতে গেছিলাম। এমনকি এও ভেবেছিলাম,যে ধনরত্নের আকর্ষনে দুস্কৃতীরা হয়তো সমাধিস্থল লুট করেছে। এমন তো আজকাল আকছার হচ্ছে। বিশেষ করে এই টালমাটাল সময়ে।কিন্ত আমার আজ্ঞাবহ দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ব্যাপারটা অন্য।
- উনি আমার পিতা। আমার জন্মদাতা। আমি কি করে ওনার অপমান সহ্য করতে পারি?
সবার মুখ ঘুরে গেলো সম্রাটের দিকে। তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
- এই সব কিছুর পেছনে....আপনি!!!
সেনাপতি জ্যা মুক্ত তীরের মতো উঠে দাঁড়ালেন।
- আপনি আমাদের সবাইকে অন্ধকারে রেখে সেই রাক্ষসকে সরিয়ে দিয়েছেন!!!
প্রধানমন্ত্রী সেই একই রকম শান্তকন্ঠে বললেন- আর আমার বিশ্বাস যদি ভুল না হয়, তবে অপদেবতা " আটেনের" পূজারী সেই রাক্ষসের স্থান হয়েছে ভূতপূর্ব মহান সম্রাটদের গণ সমাধিস্থলের কাছেই। মানে প্রায় আমাদের নাকের ডগায়। সম্রাটের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
- একি অনাচার!! একি অনাচার!!
প্রধান পুরোহিত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
- বাহহ। দারুন। এই বৈঠকের ভাঁওতা,এই সাম্রাজ্যের মিথ্যে চিন্তা - সব অভিনয়!!
প্রধান সেনাপতি গর্জন করে উঠলেন। সম্রাটের প্রতি সমস্ত স্নেহ ক্রোধাগ্নিতে মুহুর্তের মধ্যে বাষ্পীভূত হয়ে গেলো। এও তার পিতার মতোই শয়তান। হয়তো তার চেয়েও বেশী।
- যতই মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে নিজের নতুন নাম আমুন - আনখ - তাত লিখুন না কেন,ভেতরে ভেতরে এখনো আপনি সেই আটেন - আনখ - তাত রয়ে গেছেন!!! নাকি নিজেকে ঈশ্বরের থেকেও বড় মনে করছেন আজকাল? ঈশ্বরের নামের আগে নিজের নাম বসাবেন নাকি এবার? আমুন - আনখ - তাতের বদলে তাত - আনখ - আমুন???
সেনাপতির তীক্ষ্ণ অভিযোগের বর্শা আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলো সম্রাটকে।
- যাই হোক না কেন,তিনি একজন প্রজাপিতা।তার কি কোন অধিকার নেই,পবিত্র উপত্যকায় শায়িত হওয়ার?
সম্রাট মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
- তিনি...একজন... শয়তান!! আর আপনি তাকে এইখানে এনে সীমাহীন অনাচার করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ভাবলেশহীন ভাবে বললেন।
এর পরের ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলোনা। নিজের কোমরবন্ধ থেকে ছুরিকা বের করে সম্রাট হঠাত প্রধানমন্ত্রীর দিকে ধেয়ে গেলেন আহত নেকড়ের মতো। পরিনাম কি হতো বলা যায়না,যদিনা প্রধান সেনাপতি ততোধিক ক্ষিপ্রতায় সম্রাটকে নিবৃত করতেন।
- সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অভিশাপ আপনি!!! আপনি জেনেবুঝে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন যাতে আমাকে ফাঁদে ফেলা যায়। বছরের পর বছর সিংহাসনের লোভে আপনি শকুনের মতো প্রতীক্ষায় থেকেছেন। মা আমাকে বলেছিলেন আপনার লালসার কথা। আমি কান দিইনি। মুর্খ আমি।শুধু লোভী নন,আপনি অর্থগৃধণু প্রবঞ্চক লম্পট। আমি সবাইকে জানাবো আপনার কীর্তিকলাপ। আপনার মুন্ডু যদি মহান দেবতা আমুনের পায়ে গড়াগড়ি না যায় তো...। 
সম্রাট প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়লেন মানসিক উত্তেজনায়। তারপর নিজে নিজেই আবার সিংহাসনে এসে বসলেন অনেক কষ্টে। কিছুক্ষন দম নিয়ে তারপর জন্ম তৃষ্ণার্তের মতো এক ঢোঁকে অনেকটা মদিরা খেয়ে ফেললেন তিনি। অত:পর ভাঙা গলায় বললেন -
আমি কিচ্ছু জানিনা। আর আমাকে জোর করে বলানোয় আপ্নারা বাধ্য করতে পারেন না। বেরিয়ে যান সবাই এখান থেকে।
প্রধান সেনাপতি তরবারী উন্মুক্ত করে বললেন -
এই তরবারী এ মুহূর্ত থেকে আর আপনার জন্য নয়। ততক্ষন নয়,যতক্ষন আপনি আমাকে জানাচ্ছেন না,যে কোথায় আপনি সেই শয়তানকে গোপনে শায়িত করেছেন।
- আমি একটা কথাও বলবোনা।
- শুনে দু:খ পেলাম। আপনার কাছে সাম্রাজ্য বড়, না পিতৃঋণ?
প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠ যেন মাখন।
- আমার শরীর ভালো লাগছেনা। আমি এখন কিছু বলতে পারবোনা। পরে.পরে...।
উনিশ বছরের সম্রাট প্রবল মানসিক পীড়ায় বৃদ্ধদের মতো হাঁপাতে লাগলেন।
প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন এবার।
- সেই সমাধিস্থল খোঁজবার পন্থা আমরা জানি। ওটা বের করবোই।তবে সেই নির্দেশ আপনার থেকে এলে সবদিক থেকেই মঙ্গল। কথাটা ভেবে দেখবেন। আসুন প্রধান পুরোহিত। চলো হে হোরেমহেব। সম্রাটকে একটু ভাবার সময় দি।
শেষ সম্বোধনটি প্রধান সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে।
তিনজোড়া পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। দূরে পবিত্র নীল নদ বয়ে যেতে লাগলো একইভাবে। হতভাগ্য সম্রাট তুতেনখামেন ( তাত - আনখ - আমুন) বসে রইলেন।বসেই রইলেন।
নি:সঙ্গ।
একা।


আমার জবানবন্দী

ছুরি বসাবার ঠিক আগের মুহূর্তে লোকটার সাথে আমার চোখাচোখি হলো। তারপরেই চকচকে ইস্পাতের ফলাটা আমূল বসে গেলো ওর নগ্ন গায়ে। আমি ওই চোখে ভয় দেখতে চেয়েছিলাম। আতংকে ভরা ওর মুখ দেখার জন্য আমি অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কিন্ত আজ, ওকে হত্যা করার তুঙ্গ ক্ষণে এসে কেমন যেন দ্বিধায় পড়ে গেছিলাম। আমি তো খুনী নই। পারবো কি সফল হতে? ওই মুখের মধ্যে ছিঁটেফোটা মনুষ্যত্ব দেখতে পেলেও হয়তো এই কাজটা করতে পারতাম না। সৌভাগ্য আমার - তেমন কিছু হয়নি। যে লোকটা হাজার হাজার লোকের সামনে হাত ঘুরিয়ে কথার জ্বলন্ত তুবড়ি ছোটায় সে কতটা কাপুরুষ তা ওই ছুরিটা মারার ঠিক আগের মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিলাম। ওর সাথে চোখাচোখি হওয়ার সাথে সাথে। ভয় নয়,আতঙ্ক নয় - এক ধরনের বিকৃত ক্ষুধার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলাম ওই চোখে। জীবনের শেষ মুহূর্তেও ঘৃণা ওকে ছেড়ে যায়নি। আমারও তাই কোন দ্বিধা ছিলোনা। ওর কামরায় যাবার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি আমার জানা ছিলো। একটা কাগজ। ব্যাস,আর কিচ্ছু না। ওই কাগজে লেখা কয়েকটা আগড়ম বাগড়ম নাম আমাকে ওর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো। দারুন একটা টোপ। লোকটা নিজেকে গোটা সমাজের ভাগ্যনিয়ন্তা ভাবে। যেন সব্বাই ওর পেছনে ভেড়ার পালের মতো অনুসরণ করবে। নিজের মৃত্যু দিয়ে আজকে ও জেনে গেলো যে কিছু কিছু মানুষ নিজের মতো করেও ভাবতে পারে এবং শুধু পারে নয়, সে ভাবনার এতটাই জোর যে কারুর জীবন নিতেও পিছপা হয়না।

আঘাত করার সাথে সাথে বুঝতে পেরেছিলাম যে চোট মারাত্মক হয়েছে। ফিনকী দিয়ে ওর বুক থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছিলো। সেই রক্তে আমার গাউন ভিজে গেলো কিছুটা। তার মধ্যেই কাটা ছাগলের মতো ছটপট করতে করতে " বাবা গো, মরে গেলাম গো " বলে সে এমন চেল্লামেল্লি জুড়লো যে হাসি পেয়ে গেল আমার। এই নাকি দেশ কাঁপানো মুক্তিবীর!! এর ভাষ্যেই নাকি আগুন ঝরে ঝরে পড়ে!! মৃত্যুকে নিজের মধ্যে প্রবৃষ্ট হতে দেখেও মাথা উঁচু করে থাকে যে তাকেই তো বীর বলে জানি। নাকি বীরত্বের সংজ্ঞা বদলে গেছে আজকাল?

পালানোর সময় ছিলো। কিন্ত এই হাস্যকর দৃশ্য দেখতে দেখতে পেছনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার কথা খেয়ালই ছিলোনা। লোকজনের হইহল্লায়  চটকা ভেঙে দেখলাম খুব দেরী হয় গেছে। ওর সচিব, রাঁধুনী, কাজের মেয়ে আরো কারা সব হল্লা করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়েছে। ততক্ষনে সাংবাদিক বাবাজীর প্রাণপাখী ফুড়ুৎ। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে উন্মত্ত জনতা।

আমি ধরা পড়ে গেলাম।

                 **************

একটা ছোট্ট গাঁয়ে আমার ছেলেবেলা কেটেছে। সেই গাঁয়ে নদী আছে,উঁচুনীচু প্রান্তর আছে, প্রাচীন চার্চ রয়েছে, রয়েছে দুর্গের ধ্বংশাবশেষ। আমার পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল। গাঁয়ের সবাই বাবাকে খুব ভালোবাসে। বাসবে নাই বা কেন? হাসিখুশি দিলদরিয়া আবার পরামর্শ দেওয়ার সময় তীক্ষধী পুরুষ আমার পিতামহাশয়। বাবার দৌলতেই পড়াশোনা শেখা। মেয়েদের পড়তে দিতে আমাদের সমাজে সবারই একটু খুঁতখুঁতানি আছে বটে কিন্ত বাবা এসব ব্যাপারে ডোন্ট কেয়ার। ফলে শৈশব পেরোনোর চৌকাঠেই আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলো এই দেশের যাবতীয় মহান লেখকের সাথে। অনুভব করতে শিখলাম তাদের আদর্শ। লক্ষ্য করে দেখলাম কিভাবে তাদের লেখা আস্তে আস্তে মানুষের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। ঈশ্বর নয়,পরলোকের কচকচি নয় - জানাচ্ছে ইহজগতে ভালো থাকার কথা। রাজধানী থেকে বহুদুরের এই গাঁয়ে সম্রাট ও তার পারিষদবর্গের বিলাসবহুল জীবনের সব কিংবদন্তি আমাদের কানে আসতো। দারিদ্যকে চোখের সামনে দেখতাম। রাজ কর্মচারীদের অত্যাচার দেখতাম। কিন্ত এসবই তো দেখে এসেছি আমরা বিগত বহু বছর ধরে। তার মধ্যে নতুন কিছু নেই। কিন্ত আমার বয়েস যখন এগারো কেমন যেন মনে হচ্ছিলো সবকিছু ঠিক আর আগের মতো নেই। এই অঞ্চলের মাটি চিরকালই উর্বর। তবুও কম ফলনের বছর দেখা দিতো। রাজকর দেওয়ার চাপে কৃষকেরা জমি জিরেত বা গৃহপালিত পশু বিক্রি করতো মানে আরো একটু গরীব হয়ে যেতো। আবার ভালো ফসলের বছরগুলোতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে হৃত সম্পত্তি কিছু পুনরুদ্ধার করতো।না পেলে দেবতার আলয়ে গিয়ে মাথা কুটতো। শান্তি পেতো। বা পেতোনা। কিন্ত এবারে দেখলাম ফসল ভালো হওয়া সত্বেও অত্যাচার যেন বেড়েই চলেছে। এই কর সেই কর। করের উপর কর ধার্য হওয়া। খাজনা দিতে দিতে সবার বেদম অবস্থা। মা এবং দিদি হঠাত এক হপ্তার অসুখে মারা যাওয়ার পর বাবা আমাকে আর বোনকে বোর্ডিং ইস্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। বাবা তখন অন্য মানুষ। আগের বেপরোয়া লোকটা বদলে গিয়ে খিটখিটে গোছের হয়ে গেছেন। তাই আমরা খুব একটা উচ্চবাচ্চ্য না করে ইস্কুলে চলে এলাম। তবে ছোটবেলায় যে বইকে ভালবাসার বীজটা বাবা রোপন করে দিয়েছিলেন, কিশোরীবেলায় সেটাই ডালপালা মেললো বোর্ডিং ইস্কুলের বিশাল লাইব্রেরীটায়। কতদিন এমন হয়েছে যে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাকে খুঁজে না পেলে সবাই একবার লাইব্রেরীতে ঢুঁ মেরে যেতোই। ও হ্যাঁ। বইয়ের সাথে এবার যুক্ত হলো খবরের কাগজ। রাজধানীর সাথে একাত্ম হতে পারলাম এবার। জানতে পারলাম সাগরপাড়ের কোন এক দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমাদের গাম্বাট রাজা দেনার দায়ে প্রায় চুল বিকিয়ে বসে আছেন। তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। পালাবার জায়গা নেই। রাজপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে পুরোহিত - বিকিয়ে আছে সবাই। কৃষক এক টাকা দিলে রাজার কাছে হয়তো পৌঁছচ্ছে ছয় আনা। সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত। রাজধানীতে নাকি ডাক্তার উকিল বড় দোকানের ব্যবসায়ীরা সম্রাটের কাছে আবেদন পাঠাচ্ছেন। কিন্ত কোন ফল হচ্ছেনা। সম্রাট বিলাসে মত্ত। সম্রাজ্ঞী রাজদরবারের ঠাটবাটে একটি আস্ত বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে বসে আছেন। পার্টিতে, মেহফিলে অভিজাতবর্গ ডুবে রয়েছে। ওদিকে মানুষ ন্যুব্জ হচ্ছে। আরো ন্যুব্জ। তবুও সবার বিশ্বাস ছিলো যে দেশের এই টালমাটাল সময় কেটে যাবে। হয়তো যেতও। ঠিক হয়ে যেতো আগের মতোই সবকিছু।

তারপর এলো দুর্ভিক্ষ।

              ***********

জেলখানা। রাত এখন বোধহয় তিনটে হবে। আমার চোখে ঘুম নেই। কিই বা হবে ঘুমিয়ে? বিপ্লবের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড সে তো আগে থেকেই আমার জানা। তাই যেটুকু সময় চেতনা আছে, এই মরজগতের স্বাদ চেটেপুটে নিতে চাই। ওরা আমার বিচার করেছে। বস্তুত বিচারের নামে জবানবন্দি চেয়েছে। জানতে চেয়েছে আর কে কে যুক্ত আছে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে। বার বার। আমিও বারবার বলেছি যে এই হত্যার সম্পূর্ণ দায় আমার একার,আর কারুর নয়। ওদের বিশ্বাস হয়নি। একটা মেয়ে? একটা সামান্য বাইশ বছর বয়েসের মেয়ে, যার এদ্দিনে বিয়ে থা করে সংসার করার কথা নিদেনপক্ষে প্রেমিক জুটিয়ে ফুলে ঘেরা চিরবসন্তের স্বপ্নে দিন কাটাবার কথা সে কিনা একা ছুরি হাতে হত্যা করছে? তাও আবার এমন একজনকে যে অনেকের চোখে হিরো!! একটা মেয়ের ক্ষমতায় কেউ বিশ্বাসই করছিলোনা। স্বাভাবিক। গরীব ঘরের হলে তবু আলাদা,কিন্ত মোটামুটি স্বচ্ছল ঘরের হয়েও আমি কি কারনে এই ক্রান্তকালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরাবার কথা ভাবলাম সেটা সবার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। বিচারক জিজ্ঞেস করলেন - আপনি এমন কাজ করলেন কেন?

- ও একটা আবর্জনা। এই দেশের জন্য। এই সমাজের জন্য। ঘরে আবর্জনা জমলে তাকে সাফ করতে হয়। আমিও করেছি।

- আপনি কি বিপ্লববিরোধী। গণতন্ত্র বিরোধী?

- আমি অমানবিকতার বিরোধী। নিষ্ঠুরতার বিরোধী। বিপ্লবের নামে যে হত্যালীলা চলছে তার বিরোধী।

- আপনি তো অভিজাত পরিবারের মেয়ে। এটাই কি স্বাভাবিক নয় যে নতুন দিনের যে সূচনা আজ হয়েছে, রাজতন্ত্র অভিজাত ও যাজকতন্ত্রের যে সমাপ্তি এই দেশের মানুষ দেখতে চাইছে আপনি তার বিরোধী?

- প্রথমত, আমি যে অভিজাত পরিবারে বড় হয়েছি, তার মধ্যে " আভিজাত্যের " আর বিশেষ কিছু বাকী ছিলোনা। আমার পরিবার কোন সাধারন মানুষের ক্ষতি করেছে এমন কোন ঘটনা যদি মহামান্য আদালত পেশ করতে পারে তো করে দেখাক।

দ্বিতীয়ত, নতুন দিনের যে সূচনা হয়েছিলো তাতে সবার মতো আমিও অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। হ্যাঁ,একজন তথাকথিত " অভিজাত " পরিবার হওয়া সত্বেও। অভিজাত পরিবার বা গরীব পরিবারে জন্ম নেওয়া কারুর হাতে তো নেই। সুতরাং সেই মানুষ তার জীবন কিভাবে পরিচালিত করছে,সেটাই দেখা উচিত। আপনারা যে " লিবার্টি" বলেন সেখানে পরিবারতন্ত্রকে অস্বীকার করা হয়। কিন্ত আমার ক্ষেত্রে তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারন দেখানো হচ্ছে কেন?

- প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন না মাদাম। আপনি এই নতুন সময়ের বিরোধী কিনা স্পষ্টভাবে বলুন।

- না। আমার সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা আছে। আমি আগেই আপনাকে বলেছি,সেটা কি। সেই মতের সাথে আপনাদের মিল না হওয়া আপনাদের সমস্যা। আমার নয়।

- সেই মত যদিও সামাজিক পরিকাঠামোর মধ্যে অভিজাতশ্রেণীর অন্তর্ভুক্তিকেই বোঝায়।

- ঠিক। এই দেশে বহু মানুষ আছেন যারা অভিজাত বংশের হওয়া সত্বেও সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা এখন ভয়ে লুকিয়ে আছেন। তাদের এই বিপ্লবের সাথে যুক্ত করলে শক্তি বাড়তো। কিন্ত সাদা আর কালো ছাড়া আপনাদের তো আর কিছু চোখেই পড়েনা।

সহকারী বিচারক একজন কুতকুতে চোখের সন্দিগ্ধ গোছের লোক। ঘড়ঘড়ে গলায় তিনি বল্লেন - আমাদের মহান বিপ্লবী সাংবাদিককে হত্যা করার ফল কি হতে পারে জেনেও আপনি এগিয়ে এলেন কি সাহসে?

- একজন মারা যাবে,কিন্ত এক হাজার জন বাঁচার সুযোগ পাবে। তাদের মধ্যে হয়তো আপনারাও থাকবেন মহামান্য বিচারকেরা। সেই আশায়।

এই মন্তব্য শুনে সভাকক্ষে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। এমন কি কয়েকজন হাততালি দিয়ে উঠলেন। কিন্ত কারুর মুখ দেখা গেলোনা। আমার প্রত্যুত্তরে বিচারকমন্ডলী একে অপরের দিকে অস্বস্তিজনক ভাবে তাকিয়ে তড়িঘড়ি হাতুড়ি পিটিয়ে আজকের মতো আদালত মুলতুবি করলেন।

প্রহরী পরিবেষ্টিত হয়ে জেলখানায় ফেরার সময়ে দেখি লোকজন আমার দিকে ঠিক ততটা ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছেনা। সত্যি বলতে কি গত দশ মাসের নিরবিচ্ছিন্ন  এই অভিশপ্ত লগ্নের কথা ভাবলে যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বমি আসবে। কিন্ত খেটে খাওয়া সমাজের এক্কেবারে নীচের স্তরের জনগন? বহু বহু বছর ধরে পিষে পিষে এমন খেপিয়ে তোলা হয়েছে যে রক্তের খিদে ওদের আর মিটছেনা। আর এই রাজনৈতিক দল সেটা মেটাতে তো দিচ্ছেই না বরং আরো ধুনো দিচ্ছে তাতে। সেই ঘৃণার আগুন খারাপ ভালো কোনকিছুই দেখছে না,শুধু গ্রাস করে চলেছে। সেই তালিকায় যেমন উঠে আসছে অর্থগৃধনু জমিদারের নাম, তেমনি জ্ঞাণতাপস বিজ্ঞানীর নামও। আমার কাছে সান্তনা এটুকুই - এই বুভুক্ষু রাজনীতির পালে কলমের হাওয়া যিনি দিতেন সেই বিকৃতমস্তিস্ক কে আমি চুপ করিয়ে দিয়েছি।

তৃতীয় দিনের বিচারের পর রায় ঘোষনা হলো। বিরোধীপক্ষের কারুর নাম না পেয়ে হতাশ আদালত রায় শোনালো ভীড়ে ঠাসা কক্ষে। জনতা উল্লাস করে উঠলো। দু একটা হাহাকার ধ্বনি হয়তো উঠেছিল। আমি শুনতে পাইনি।

আগামী কাল আমায় শাস্তি দেওয়া হবে।

আমার শাস্তি : শিরোচ্ছেদ।

            **************

প্রথম বছরে ফসল ভালো না হওয়ায় সবাই চিন্তিত ছিলো। দ্বিতীয় বছরেও সেই একই ব্যাপার হওয়ায় চেপে বসলো ভয়। তৃতীয় বছরের ভয়ঙ্কর শীতের দীর্ঘ রাতে আগুনের চারিদিকে বসে কাঁপতে কাঁপতে সবাই বুঝতে পারছিলো যে আর রক্ষা নেই। গৃহপালিত পশু মারা যেতে শুরু করলো সেই অকল্পনীয় ঠান্ডায়। বরফে ঢাকা আপেল বাগান, তুষারের আবরনে মোড়া যব বার্লির ক্ষেত দেখে বুঝতে বাকী রইলো না যে দুর্ভিক্ষ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে।এ অঞ্চলে রুটি মাংসের অভাব সেভাবে হয়নি কখনো। এইবারে মাংস তো দুরস্থান, মোটা বাসী পাঁউরুটি পর্যন্ত হলো অমিল। যে টাকায় পাঁচটা রুটি পাওয়া যেতো,সেখানে দুটো হয় কিনা সন্দেহ। তাও যদি যোগান ঠিকঠাক থাকে। এর মধ্যেও সাধারণ মানুষ কোনক্রমে টিঁকে যাচ্ছিলো,কিন্ত তার সাথে জমা হোলো বিশাল করের বোঝা,যা কমানোর কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছিলোনা সরকারপক্ষ থেকে। সবকিছু মিলিয়ে গ্রামগুলোতে ত্রাহি ত্রাহি দশা। শহরের অবস্থাও তথৈবচ - জানা গেলো সংবাদপত্র মারফত। একজন মজুরের আয়ের বারো আনা বেরিয়ে যাচ্ছে শুধু রুটি কিনতে। জনতা বিক্ষুব্ধ। রাজতন্ত্র অবিচলিত। অর্থমন্ত্রী ভালো কিছু করতে গেলেও নাকি সম্রাট বাধা দিচ্ছেন।

এখন ভাবতে অবাক লাগে যে সংবাদপত্র   কিভাবে এই রাজবিরোধী খবর নির্ভয়ে ছাপতে পারছিলো!! আসলে এটাই সেই সময় যখন রাষ্ট্রকে কেউ ভয় পাচ্ছিলোনা। রাষ্ট্র একজনের চুলের মুঠি ধরতে গেলে অন্য আরেকজন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিলো আর শাসনদন্ড মাথার উপর বনবন করে ঘোরানো ছাড়া শাসক আর কিছুই করতে পারছিলোনা তখন। এই সেই সন্ধিক্ষন যার অপেক্ষায় শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায়। রাজধানী থেকে বহুদুরে আমাদের গ্রামেও সেই জাদু সময়ের ঢেউ এসে লাগছিলো। অভিজাতদের দিকে দৃষ্টি হয়ে উঠতে লাগলো বাঁকা। যাজকদের আহৃত ধনসম্পত্তি ভগবানের কাজে না লাগিয়ে মানুষের কাজে লাগানোই ভালো - হাওয়ায় ভাসতে লাগলো এই মত।

এসবের মধ্যেও আমি হয়তো গড়পড়তা মেয়েদের মতোই সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া গা ছমছম দিন কাটিয়ে যেতাম। জীবনে প্রথম ছেলেদের চোখের ভাষা বুঝতে পারছিলাম। দেহে এবং মনে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিলো। তাই দেশ যে এমন একটা ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে হাল্কা রোমাঞ্চ হচ্ছিল কিন্ত তার সাথে নিজেকে একাত্ম করার কোন তাগিদ পাচ্ছিলাম না।

সেই তাগিদটা এলো আমাদের গ্রামে কিছু নতুন চরিত্রের আবির্ভাব হওয়ার পর। তাদের  কেউ এসেছে রাজধানী থেকে,কেউ বা অন্যান্য শহরের। তাদের বক্তব্য ক্ষুরধার, কন্ঠস্বর দৃপ্ত আর বক্তব্য দ্বিধাহীন। তাদের একটাই কথা : যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।

এদের মুখেই আমি প্রথমবার নতুন একটা শব্দ শুনলাম। সেটা শোনার এবং তার অর্থ বোধগম্য হওয়ার পর থেকে আমার মধ্যে কেউ যেন শীতঘুম ভেঙে জেগে উঠলো। এই শব্দটা এরপরে আরো অনেকবার ব্যবহৃত হবে। বক্তৃতায়, লোকমুখে এমনকি যে লোকটাকে আমি খুন করলাম তার সম্পাদকীয়তেও। বারবার শুনে শুনে সেই শব্দটা ক্লিশে হয়ে যাবে। তার ঝাঁঝ কমে যাবে। কিন্ত সেই সময়ে, সেই জাদু সময়ে,শব্দটা শুনলেই দেহের মধ্যে রিনরিন করে উঠতো।ঘুমোতে যাওয়ার আগে ঈশ্বর ভজনা করে তারপর নিদ্রামগ্ন হওয়াই নিয়ম। আমি ঈশ্বরকে ডাকতাম না আর। ঠোঁট নড়তো। মা ভাবতো ভগবানকে ডাকছি আর আমি অস্ফুটে ওই শব্দটাই জিভের মধ্যে চিনির ডেলা ঘোরানোর মতো বারবার বলতাম। আমার মন্ত্র। আমার প্রার্থনা।

- বিপ্লব!! বিপ্লব!! বিপ্লব!!!

সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিনটা রোদ ঝলমলে দেখে যাবো। কপাল মন্দ। এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে যেতে হবে। আমাকে লাল রঙের আংরাখা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছুক্ষন আগে।বিশ্বাসঘাতকদের এটাই পরানোর নিয়ম। সেই পরে সং সেজে বসে আছি মৃত্যুর অপেক্ষায়। ওহ হ্যাঁ,একটা মজার কথা বলতে ভুলে গেছি। এর মধ্যে আমি একটা ছবি আঁকিয়ে নিয়েছি নিজের। ব্যাপারটা আদতে ভারী মজার। কোর্টে যখন আমার শুনানীর যাত্রাপালা চলছিল তখন একজন সেনা অফিসার ( আমাকে দেখে তার কি মনে হয়েছিল কে জানে) আমার কিছু স্কেচ করতে শুরু করে। কাঠগড়া থেকে আমি তা লক্ষ্য করেছিলাম। বেশ ঘাড় বেঁকিয়ে টেকিয়ে খসখস করে পেন্সিল বুলিয়ে যেতো আর আমার দিকে তাকাতো চোরাগোপ্তা। আদালতের গম্ভীর দমবন্ধ করা পরিবেশে সে এক আজব দৃশ্য। দু একবার চোখে চোখ পড়াতে বিব্রত হয়ে মাথা টাথা নামিয়ে নিতো। শুনানি শেষ হবার পরে আমি ওই চোখের দিকে তাকিয়ে এক সমুদ্র ঘৃনার মাঝখানে এক আঁজলা মিঠে জল দেখতে চেয়েছিলাম।

কি দেখেছিলাম ?

সে প্রশ্ন থাক।

আদালতের কাছে এর পরেই আমি আপিল করি, যদি আমার একটা পোট্রেট করবার অনুমতি পাওয়া যায় তো মৃত্যুর আগের সময়টুকু অতোটা দুর্বিষহ লাগবেনা। আদালত অনুমতি দিলো এবং জানতে চাইলো এমন কেউ আছে কিনা। আমি সটান আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম বাবাজীর দিকে। সে তখন কাগজ পেন্সিল এক হাতে আর গাদা বন্দুক আরেক হাতে নিয়ে গুটিগুটি নিজের পথ ধরতে ব্যস্ত। বিচারপতির ডাক শুনে বেচারা ভির্মি খায় আর কি। আমি পাবলিকের শত্তুর বলে কথা। এইরকম রোমহর্ষক মামলায় কেউই চায় না তার নাম জড়াক। যাইহোক অনেক বুঝিয়ে শুঝিয়ে তাকে যখন জানানো হলো আহ্বানের কারন তিনি তো  একপায়ে খাড়া হয়ে গেলেন। আমি ভেবেছিলাম ব্যাটাকে বেশ প্যাঁচে ফেলা গেছে। ও মা!!! এ তো দেখি বাড়ি দেখে ইজেল আর ক্যানভাস নিয়ে হাজির। কি আর করা কাঠ হয়ে সেপাইবাবুর সামনে বসতেই হোলো। জানলাম ওর গল্প। দেশের দক্ষিন ভাগের সমুদ্রঘেঁষা এক ছোট্ট বন্দরে ওর বাড়ি। বাপ নাবিক এবং তুখোড় মাতাল। মা অন্য লোকের সাথে ভাগলবা। তিন ভাই এক বোনের সংসারে অভাবের নিত্য চাবুক। দেশের সৈন্যবাহিনী কাজ যোগাড়ের চেষ্টায় ছেলেটা রাজধানীতে এসেছিলো। যেমন আরো হাজার হাজার আসে। এসেই দিনবদলের ঝোড়ো সময়ের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। ওর রাজার ওপর বিশেষ বিরাগ নেই। আবার ভালবাসাও নেই। মোটামুটি দুবেলা পেট চললেই সে অস্ত্র হাতে তুলতে রাজী। বিপ্লব এবং তার পরবর্তী ভানুমতী কা খেল তাকে অফিসার পদে বসিয়ে দিয়েছে।

- রাজামশায়ের মুন্ডুটা যখন সবাইকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছিলো - আমিও খুব হাততালি দিচ্ছিলাম । তারপর বিকেল থেকে কি বমি!! কি বমি!! আসলে রক্ত খুব একটা সহ্য করতে পারিনা জানেন। "

বিষন্ন ভাবে বললো জন।

- তাহলে সৈন্যবাহিনীতে যুক্ত হলেন কেন?

- খুব দ্রুত টাকার দরকার ছিলো। আর কোন চাকরী পাচ্ছিলাম না। তাই,,,।

- আর এই ছবি আঁকা?

কারাগারের ছোট্ট ঘুলঘুলি থেকে আসা তেরছা আলোর রশ্মির দিকে তাকিয়ে জন বললো - আমার এক তুতো কাকা আছে। মানে ছিলো আর কি। পাত্তা নেই তো নেই। তারপর দুম করে একদিন হাজির হোলো একগাদা টাকা নিয়ে। সে টাকা কোত্থেকে যোগাড় হতো কেউ জানেনা। অভাবের সংসারে অত কৌতুহলে লাভ কি। বাবা তখন বাড়িতে থাকলে ভালোই। না থাকলে তো দুনি মজা। কাকা নানারকম ফিকির জানতো। যার মধ্যে এই একটা। কাকার পাশে বসে বসে আমারও শখ হোতো তুলির আঁচড় কাটি। সেই থেকেই শুরু।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম জনের দিকে। কি হওয়ার কথা ছিলো ছেলেটার আর কি হয়ে গেলো। হয়তো ঝোড়ো সময়ের দস্তুরই এমনটা। মানুষের পথ বদলে দেয় রাতারাতি।

- তুমি এই পথ বেছে না নিয়ে যদি পড়াশোনার দিকে যেতে, তাহলে হয়তো সবার পক্ষেই ভালো হোতো, তাই না?

জন জিজ্ঞেস করেছিলো আমায়।

- হ্যাঁ,সে তো হোতোই। তুমি বেশ ছবি টবি আঁকতে আর আমি ভারী ভারী বই পড়ে...।

বলেই নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। আমার গালের লালিমা কি জন দেখতে পেয়েছিলো?


বৃষ্টি পড়ছে। পড়েই যাচ্ছে। তাতে ধুয়ে যাচ্ছে রক্ত, ক্লেদ, বঞ্চনা। মাথাচাড়া দিচ্ছে নতুন দিনের অংকুর। বিপ্লবের চারাগাছ।


কিন্ত যে শিল্পীর জীবন যুদ্ধবাজে বদলে গেলো অথবা যে মেয়েটা পড়াশোনা নিয়ে থাকার বদলে হয়ে গেলো ঘাতক - সেই নষ্ট জীবনের ভার কোন বিপ্লব বইবে?

একদিকে মহিয়সী একজন নারী। অন্যদিকে ক্ষমতালিপ্সু জনগণেশের হাততালিতে আঙুল ফুলে কলাগাছ এক পিশাচ। লড়াইটা ক্রমে এই জায়গায় চলে এসেছিলো। রাজতন্ত্রের নাগপাশ থেকে বেরোন একধাপে হয়নি,বলাই বাহুল্য। তার মধ্যে অনেক আগুপিছু,অনেক রক্ত ঝরা দিন আমরা দেখেছি। দেখেছি বহুযুগ ধরে চেপে রাখা মানুষের ক্ষোভ কিভাবে আক্ষরিক অর্থেই ধ্বসিয়ে দিতে পারে দুর্গের প্রাচীর। দেখেছি " চুনোপুঁটি " লোকদের সাথে বসবাস করতে না পারা রাজপরিবার কিভাবে সুড়সুড় করে ফিরে আসতে পারে নোংরা রাজধানীতে। এ সমস্তই আমরা সংবাদপত্রে পড়তাম।কিন্ত সেই একই বর্ণনা যে নারীর মুখে শুনে আমার গোটা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতো, প্রথম বার তাকে দেখি ষোলো বছর বয়েসে। মহিলাদের ভূমিকা আমাদের সমাজে খুব একটা পাতে দেওয়ার মতো নয়। ইনি সেইখানে উদিত হলেন নিজের তেজে। প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ, ওজস্বী সব বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন দেশময়। তার বক্তব্য ছিলো সোজাসাপ্টা। সাধারণ মানুষের জন্য চাই সাধারণ মানুষের সরকার। কিন্ত সরকার স্থাপন হবে যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ ভাবে। প্রাচীন গ্রিক ও রোমের গণতন্ত্রের কথা তিনি বারবার উল্লেখ করতেন। আমরা সেই ঐতিহ্য সাময়িক ভাবে ভুলেছি মাত্র - কিন্ত আবার তা পুনরুদ্ধার করা যায়। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে নবজাগরণ হলে রাজনীতিতেও বা হবেনা কেন?

- আমরা চাই রিপাবলিক। চাই রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি। আর অন্য কোন পন্থা নেই। ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন আমি আপনি সবাই দেখেছি, তা আজ আমাদের চোখের সামনে বাস্তব হয়ে উঠছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? এখন - এই সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে আমাদের জানতে হবে কি ভাবে তা আমাদের করায়ত্ত হতে পারে।

মাদামের বক্তব্য শুনতে লোকে ভীড় করে আসতো। তার কন্ঠস্বরে ছিলো এমন কোন জাদু যে লোকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো।
আমিও শুনতাম। তার কথা এবং তার লেখা পড়ে আমি তার ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। দু:খের কথা, যে তার এবং বিপ্লবীদের সাচ্চা সমর্থকদের প্রভাব আমাদের দেশে ক্রমশ আলগা হতে থাকলো।

কেন? জনপ্রিয়তার ধান্দা করা রাজনীতি তারা করতেন না বলে। দেশের টালমাটাল সময়ে যথাসম্ভব কম রক্তপাতে সাধারণ মানুষের হাতে কিভাবে ক্ষমতা  আনা যায়,তাদের ছিলো সেই প্রচেষ্টা। কিন্ত  মানুষ? তারা চাইছিলো উত্তেজনা। তাই আস্তে আস্তে স্থান দখল করে নিলো কিছু ধান্দাবাজ এবং বিকৃত লোক যারা শুধু পোড়াতে ভালোবাসে। বিপ্লবকে সামনে রেখে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একের পর এক নিরপরাধ মানুষকে হত্যার ফরমান জারি করতে শুরু করলো। আর সেই মৃত্যু পরোয়ানা তৈরিতে যার সবচেয়ে বড় হাত তিনি ছিলেন এক সাংবাদিক।  নানা রকম দিক থেকে জোগাড় করতেন নাম, যারা নাকি বিপ্লবী আদর্শের পরিপন্থী, যারা রাজতন্ত্রের গোপন সমর্থক। তাদের টেনে হিঁচড়ে আনা হোতো রাজধানীতে। হতেন কারারুদ্ধ। চলতো অত্যাচার। সে অবধি ঠিক ছিলো। কিন্ত ইদানীং অধিকাংশ অপরাধের শাস্তি একটাই। মৃত্যুদণ্ড। অপরাধও একটাই। বিশ্বাসঘাতকতা। সেই বিশ্বাসঘাতকের লিস্টি তৈরি করছেন কে? সেই সাংবাদিক। একেক দিনের কাগজে নতুন লিস্ট বেরোয় আর অপরাধীদের মুন্ডুগুলো গড়াগড়ি যায়। আমি, আমার দেশের মানুষ, বর্তমানে ঠিক এইরকম রক্তাক্ত সময়ে বাস করছি।

তবুও মেনে নিচ্ছিলাম। যা হচ্ছিলো, ঠিক হচ্ছিলো না একেবারেই। তবুও হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মতো আমিও নিয়তিবাদী হয়ে মেনে নিচ্ছিলাম সেইসব। আমার ব্যক্তিগত সেই নির্লিপ্ততা একদিন ছারখার হয়ে গেলো।

মাদাম, দেশের মানুষকে প্রাণপণে ভালোবাসতেন যিনি, প্রতি মূহুর্তে রিপাবলিকের স্বপ্ন বুকে নিয়ে জেগে থাকতেন যিনি - গ্রেপ্তার হলেন বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে।

 একটা নয় ইঞ্চির ছুরি। ফলাটা চকচক করছে মোমবাতির আলোয়। আর আমি সেই সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবছি, কাল একজন মানুষকে হত্যা করতে কি সত্যিই পারবো? মাদাম নিজে কি চাইবেন? তিনি এই জাতীয় প্রতিশোধ রাজনীতির বিরোধিতাই তো করে এলেন। তার গ্রেপ্তারীর বদলা কি হত্যা দিয়েই নিতে হবে? আরেকটু তলিয়ে ভাবার ফলে অবশ্য এই সঙ্কট আস্তে আস্তে মুছে যেতে লাগলো। মাদামের গ্রেপ্তারী তো একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমার জেহাদ তো তাদের বিরুদ্ধে যেখানে কয়েকজন মানুষ রিপাবলিকের নামে শেষমেষ ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে।

বিচারক জিজ্ঞেস করেছিলেন - এই হত্যাকান্ডের শাস্তিস্বরুপ তুমি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতে পারো। তবুও করলে কেন?

উত্তর দিয়েছিলাম - একজনের মৃত্যুর বিনিময়ে এক হাজার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করা লজ্জার নয়, বরং গর্বের কাজ।

রাতে ঘুমোতে পারলাম না উত্তেজনায়।

পরদিন সকাল। সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে সাংবাদিক মশায়ের বাড়ির পথ ধরলাম। যে সরাই খানায় উঠেছিলাম তার থেকে বাড়িটার দূরত্ব হেঁটে মিনিট পনেরো। গাউনের ভাঁজে লোকানো আছে ওকে হত্যার পরোয়ানা। ডানহাতে রয়েছে একটা চিঠি। হ্যাঁ,ঠিকই শুনেছেন। চিঠি। অবাক হবেন না। কোন প্রেমপত্র নয়। ওই নচ্ছারকে জব্দ করার উপায় অন্য। ওই চিঠির মধ্যে একটা লিস্ট রয়েছে। বিশ্বাসঘাতকদের লিস্ট। সাংবাদিক আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ এখন ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো বলির পাঁঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিরোধীতার গন্ধ পেলেই তাকে রাষ্ট্রীয় মদতে খুন করা হচ্ছে। রাজ্য জুড়ে গুপ্তচর ছড়ানো। তারা অসন্তোষের জল মেপে বেড়াচ্ছে। কোথাও একটু বেচাল দেখলেই জানানো হচ্ছে রাজধানীতে বসে থাকা স্বঘোষিত " দেশোদ্ধার কমিটি" কে আর রক্তে ভেজানো জল্লাদের মঞ্চ হয়ে উঠছে আরো একটু রাঙা।

এই লিস্ট হচ্ছে আমার ছাড়পত্র। নামগুলো অবশ্যই ভুয়ো। ওটা শুধু লোকটার নাগালের মধ্যে যাওয়ার জন্য। এরকমই লিস্ট ও নিজের ছাপানো কাগজে বড় বড় অক্ষরে বের করে। হইচই পড়ে রাজ্য জুড়ে। লিস্টের মধ্যে যাদের নাম, যমরাজের খাতায় তাদের সইসাবুদ মোটামুটি পাকা। তাদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি চালানো হয়। সাধারণ মানুষও সোল্লাসে যোগ দেয় তাতে। ধরা পড়লে বিচারের প্রহশন আর কয়েক হপ্তার মধ্যেই ধড় একদিকে মুন্ডু আরেকদিকে। সীমাহীন বীভৎসতা রাজধানীর আকাশে কালো শকুনের মতো ডানা মেলে আছে এখন।

আমি আজ ওই শকুনের চোখকে উপড়ে ফেলবো।

বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লাম। একটা  কাজের ঝি উঁকি দিলো।

- কি ব্যাপার?

- আমি মঁসিয়ে মারাটের সাথে দেখা করতে এসেছি।

ঝিটা তার কুতকুতে চোখে আমাকে আপাদমস্তক দেখে বল্লো - বাবু এখন ব্যস্ত আছেন। বিকেলে এসো। পাঁচটার পর।

- একটা জরুরি কাগজ দেওয়ার আছে।

- আহহ। বল্লাম না বিকেলে এসো। বাবু এখন গায়ে ওষুধ মাখছেন। সাথে লেখালিখিও কচ্ছেন। এখন দেখা হবেনা।

সেরেছে। তীরে এসে তরী ডুববে নাকি! ছক কাটা পরিকল্পনা কি একটা ঝিয়ের জন্য ভেস্তে যাবে!

আমার ভাগ্য ভালো যে ঠিক সেই সময়ে ভেতর বাড়ি থেকে কেউ ঝি টাকে ডাকলো

- কি ব্যাপার রে সোফিয়া?

পুরুষ কন্ঠ।

- দ্যাকেন না, কে ঝ্যানো একটা ছুঁড়ি এসেচে বাবুর সাথে দেখা করবে। সাথে কি লিস্টি,,,

- ডাক ডাক,, ভেতরে ডাক!!

ঝি থতমত ভাবে দরজা খুলে দিলো।

দরজার ওপারে ছোট্ট একটা খোলা জায়গা। হাবিজাবি কাগজ পত্তর ডাঁই করে রাখা আছে। বাঁদিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন আধবুড়ো লোক।

- কি নাম আপনার?

নাম বললাম। ভুয়ো অবশ্য। কোত্থেকে এসেছি সেটাও বল্লাম।

- কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়ার আছে মঁসিয়ে কে।

- আমাকে দিয়ে যেতে পারেন। আমি যথাস্থানে পৌঁছে দেবো।

ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বল্লেন। এই ঝামেলার জন্য অবশ্য তৈরিই ছিলাম।

- দু:খিত। আমার উপর নির্দেশ আছে লিস্ট ওনাকেই দেওয়ার।

- আমি ওনার সচিব। আমাকে নির্দ্বিধায় দিতে পারেন।

- মাপ করবেন। নির্দেশের বাইরে যেতে পারবোনা।

লোকটা সরু চোখে তাকালো আমার দিকে। ঠিক পাঁচ সেকেন্ড। আমি দৃষ্টি সরালাম না। ওনার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করছে সব। 

- বেশ। তবে আমাকে আগে ওনার অনুমতি নিতে হবে। অপেক্ষা করুন।

বসলাম একটা গার্ডেন চেয়ারে। কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কেটে গেলো। দুয়েকজন প্রেসের লোকজন দেখলাম ব্যস্তভাবে কাগজ পত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। পাশের বাড়ি থেকে হঠাত আর্তনাদ ভেসে এলো একটা। চমকে উঠতেই সামনে দিয়ে একজন কর্মচারী যেতে যেতে বলল - সকাল থেকে এই নিয়ে পাঁঁচবার।

- মানে,এটা কি হচ্ছে,,,,

আমি কিন্তমিন্ত করে জিজ্ঞেস করলাম।

- ওই দাঁত তোলা হচ্ছে আর কি। দাঁত থাকলেই দাঁত ব্যথা হয় কি না।

বোঝ কান্ড। আমি ভাবলাম সাংবাদিক মশাই বোধহয় বাড়ির পাশে উতপীড়নের ঘরও খুলেছেন। গলা শুকিয়ে এসেছিলো উত্তেজনায়। একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম একটু জলের জন্য। সে বিরক্তিভরা মুখে " দেখছি " বলে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো কে জানে। নিজেই উঠে খোঁজ করতে যাবো কিনা ভাবছি ঠিক তখনি -

 আপনি চলে আসুন।

বুকটা ধক করে উঠল। কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আমি তো আর পেশাদার খুনী নই যে ঠান্ডা মাথায় কাজ সেরে গা ঢাকা দেবো। হাত দিয়ে অনুভব করে নিলাম ছুরিটা ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর এগোতে লাগলাম।  সিঁড়িটা যেখানে শেষ হচ্ছে তার ঠিক পরেই একটা অনতিউচ্চ দরজা রয়েছে। সেখান থেকেই ওই আধবুড়ো সচিব ডাকছেন আমায়।

- এই করিডর ধরে সোজা চলে যান। মঁসিয়ে এখন ওষধি নিচ্ছেন। স্নানঘরে।

স্নানঘরে? দেশের ভালো করার জন্য শেষে পুরুষ মানুষের স্নানঘরে ঢুকতে হবে?

ভদ্রলোক বোধহয় আমার মানসিক অবস্থা বুঝলেন। আশ্বাস দিলেন যে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। একটা বাথটবের মধ্যে উনি নিজেকে ডুবিয়ে রেখে সারা শরীরে ওষধি নিচ্ছেন। নাকি চর্মরোগ ঠিক করার দাওয়াই এটা।

- করিডরের শেষে, বাঁদিকে একটা ছোট দরজা আছে। ওখানেই ঢুকে যাবেন। এই চর্মরোগের কারনে মঁসিয়ে আজকাল লোকজনের সামনে আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। সারাদিন ওখানেই প্রায় থাকেন। মেজাজও খিটখিটে হয়ে গেছে।

" পাপের ফল "। মনে মনে ভাবলাম।

দ্বিধান্বিত পদক্ষেপে ঢুকলাম স্নানঘরে। সারা ঘরে জমে আছে একটা সব্জেটে অন্ধকার আর ওষুধের গন্ধ। ঘরের ঠিক মাঝখানে জ্বলছে মোমবাতি। সেই মোমবাতির কাছেই লম্বালম্বি গোছের অদ্ভুত আকারের একটা কাঠের বাথটব। সেখানেই অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় সারা মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে খসখস করে লিখে যাচ্ছেন তিনি। সাধারণ মানুষের মহান ত্রাতা, রাজশক্তির যম, পরমপুরুষ মঁঁসিয়ে পল মারাট।

ঘরে আমার পায়ের শব্দে তিনি ফিরে তাকালেন। " শকুন " বিশেষণ সত্যিই খাটে ওই মুখশ্রীর সাথে। আস্তে আস্তে ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার ডান হাতে লুকিয়ে রেখেছি ছোরা। বাঁ হাতে পাকানো কাগজটা।

- কই,দেখি কি লিস্ট।

আমি ওনার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালাম।

- কি ব্যাপার?

- মাদাম কি দোষ করেছিলেন?

- কি?

- কেন আপনি তার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ এনেছেন? নীচ,প্রবঞ্চক, মিথ্যাবাদী!! আমি দাবী করছি, এই মূহুর্তে আপনি ওনার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করবেন!

আমি জানি না কেন ওই কথাগুলো বলেছিলাম। হয়তো মানুষ খুন করার মতো চরমপন্থার প্রতি তখনও মন সায় দিচ্ছিলো না।

লোকটা খানিক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর ওর মুখ ভরে উঠলো কুটিল হাসিতে।

- ওহহ। এটা একটা ফাঁদ। বাব্বা। সাহস আছে বলতে হবে আপনার। মাদাম দেখছি মাথাটা ভালো করেই ধোলাই করেছেন। এখান থেকে হাতে হাতকড়া পরে বেরোতে হবে, সেটা বুঝতে পারছেন কি?

- আপনি মাদামকে মুক্ত করার সুপারিশ করবেন কি না!!!

আমাকে একবার আপাদমস্তক মেপে নিয়ে আবার লেখার দিকে মনোনিবেশ করে লোকটা বললো - আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। চুপচাপ কেটে পড়ুন। আর একটা কথা বললে পেয়াদার দল আপনাকে এখান থেকে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাবে। নেহাত কচি বয়স,নইলে এই সুযোগটাও দিতাম না।

হঠাত খুব দুর্বল লাগলো নিজেকে। শরীরের সব শক্তি যেন কেউ নি:শেষে শুষে নিয়েছে। দরজার দিকে এক পা কি বাড়িয়েও দিয়েছিলাম। লোকটা বেঁচে যেতো। আমিও ভগ্নমনোরথ হয়ে গ্রামে ফিরে আসতাম। কিছুই হতো না আর, যদি না  হঠাত ও বলে উঠতো -

 আর হ্যাঁ শুনুন। আপনার মাদামের মুন্ডু যাতে শিগগির গড়াগড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়,আমি সেই চেষ্টাই করবো। সব এখন আমার অঙ্গুলিলেহনে চলে।

 মাথার মধ্যে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এত অহঙ্কার!! এত স্পর্ধা!!  ছোরাটা বের করলাম গাউন থেকে। একেবারে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালাম। লোকটা খেঁকিয়ে উঠে কিছু বলার জন্য মুখ তুলতেই আমার হাতে ছোরা দেখে কেমন ভেবলে গেলো। তারপর একটা বিকৃত মুখভঙ্গি করে চেঁচিয়ে উঠলো - বাঁচাওও!!! বাঁচাওওওও।

আর বিশেষ কিছু বলার সুযোগ ও পায়নি। ছোরাটা আমূল বসিয়ে দিলাম বুকে। প্রায় চোখ বন্ধ করে,আনাড়ির মতো। কিমাশ্চর্যম। এক আঘাতেই ইস্পাত লক্ষ্যভেদ করলো। ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে এসে বাথটব লাল করে তুললো এক মুহূর্তে । আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বীভৎস। আবার একই সাথে - তৃপ্তিদায়ক।

আজ আমার জীবনের শেষ দিন। সংক্ষিপ্ত জীবন। প্রায় শেষ পর্যন্ত গড়পড়তা , অন্য সবার মতোই জীবন। ব্যর্থ না সফল? সেটা ইতিহাস বলবে। কোনো অনুশোচনা থেকে গেলো কি? তা তো থাকলোই। বিপ্লব পরবর্তী আমার দেশ কি রকম হবে সেটা দেখার ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গেলো। দক্ষিন সমুদ্রতটে যাওয়ার ভারী ইচ্ছে ছিলো। সেটাও বাকী থেকে গেলো। ওই যে ছেলেটা আমার ছবিতে শেষ তুলির টান লাগাচ্ছে, ওর সাথে আরো কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিলো। তাও আর হবেনা।

- একবার দেখে যাবেন।

রুদ্ধকন্ঠে জন ডাকলো আমাকে।

ছবিটার কাছে গেলাম। বাহ!! তুলিতে ওর সত্যিই মুন্সিয়ানা আছে। আমি এমন কিছু আহামরি সুন্দরী নই বলেই ধারনা ছিলো। এখন দেখছি চলনসই সুশ্রী বলা যেতেই পারে। তবে এর মধ্যে কতটা বাস্তব আর কতটা জনের হাত সেটা অবশ্য বলা মুশকিল।

জনের দিকে এগিয়ে গেলাম।

- তোমার দক্ষিনাটা বাকী থেকে গেলো।

জন ম্লান হাসি হাসলো একটা।

- আগে বলুন পছন্দ হোলো কিনা।

আমি দু একটা ছোট্ট জায়গা বদলাতে বল্লাম। গালে আরেকটু লালিমা হলে ভালো হয় ( কোন মেয়েরই বা ইচ্ছে করে না এমনটা) আর চোখের রঙ,আমার ধারনায় আরেকটু গাঢ় হলে বেশ হয়।

- চোখের রঙটা বরং আমার পছন্দের থাক। ওটাই দক্ষিনা।

আমি নির্নিমেষে তাকালাম জনের দিকে। অন্য কোন সময়ে,অন্য কোন পরিস্থিতিতে এই পরিচয় কোথায় যেতো, কে জানে?

কারাগারের দরজা খুললো। সময় হয়েছে। চারজন রক্ষী এসে দাঁড়ালেন ভেতরে। আগে হয়তো পেছন পেছন একজন যাজকও আসতেন। এখন সেসব পাট চুকেবুকে গেছে। আমারও দরকার নেই।একটা লাল রঙের আংরাখা পরিয়ে দেওয়া হলো। বিশ্বাসঘাতকদের এটা পরতে হয়। তারপর একজন আধবুড়ো গোছের অফিসার এগিয়ে এসে বললেন - মাদাম শার্লট কোরদে,, মহামান্য জাতীয় আদালতের আদেশানুক্রমে, আমাদের সবার প্রিয় পিতৃভূমি ফ্রান্সের বিপ্লব প্রচেষ্টার মহান সংকল্পে বাধা দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজে নিয়োজিত হওয়ার জন্য তথা নবযুগের কান্ডারী, মণীষী জন মারাটকে নির্মমভাবে হত্যার জন্য আপনাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেছেন।

আপনার কোন অন্তিম বক্তব্য আছে?

অফিসারটির সাথে একজন লিপিকার এসেছেন। সব ঘটনাবলি টুকে রাখা ওনার কাজ। তিনি অত:পর খাতা কলম নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বলা যায়না,শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গীসাথীদের নাম বলে দিয়ে প্রাণ ভিক্ষাও তো চাইতে পারি।

আমি কারাগারের ছোট্ট জানালার বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর দিকে তাকালাম একবার।

- হায়, স্বাধীনতা....।

লিপিকার বাবু হতাশ হলেন।ব্যাস,এটুকুই?
অফিসার মশাইও বোধহয় মনে মনে মাথা চুলকোলেন একবার।

- বেশ। ইয়ে, তবে এবার,,,।

- চলুন। আমি প্রস্তুত।

উঠে দাঁড়ালাম। জন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বল্লাম - কি মশাই,মাদামকে বিদায় জানাবেন না?

ও ঝুঁকে পড়ে আমার হাত চুম্বন করল। তারপর সেই হাত ধরে কেঁদেই ফেললো ঝরঝর করে। আমি ওর মাথার চুল একবার ঘেঁটে দিলাম।

- ছবি আঁকাটা ছেড়োনা। আসি?

চলে আসা মাঝে মাঝে কত যে কঠিন,,,।

কারাগার থেকে বেরোতেই উন্মত্ত জনতার উল্লাস শোনা গেলো। পাঁচীলের ওপার এখন উত্তাল। আমাকে একটা খাঁচা গোছের গাড়িতে পোরা হোলো আমারই নিরাপত্তার জন্য। যদি আধলা ইঁট ছোঁড়ে কেউ? আমার মাথা ফাটবে। তখন আবার সুস্থ হবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তদ্দিন প্রাণদন্ড পিছিয়ে যাবে। কম ঝামেলা? কদ্দিন ধরে সবাই অপেক্ষা করছে বিপ্লবের বরপুত্রের খুনীর পটল তোলা দেখার জন্য। এই আমোদে বাধা দেওয়া তো রাষ্ট্রীয় অপরাধ!

অঝোর বৃষ্টির মধ্যে খাঁচায় পোরা জন্তুর মতো আমাকে নিয়ে আসা হোলো বধ্যভূমিতে। চারিদিকে গালাগালি আর টিককিরির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পচা ফল আর সব্জি ছোঁড়া হচ্ছে বারবার। আমার চোখ অবশ্য সামনের দিকে। সেখানে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে এ যুগের সবচেয়ে নিখুঁত হত্যার কল।

গিলোটিন।

এর নাম শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। হাজারে হাজারে নিরপরাধের প্রাণ মিলিয়ে গেছে এর অতিকায় মারণ জাতাকলের নীচে। অথচ আজ ওটাকে দেখে খুব একটা মারাত্মক কিছু মনে হোলো না।যেন ও নিজেও একটা পরিস্থিতির শিকার।

 বৃষ্টি নাছোড়বান্দার মতো পড়েই যাচ্ছে। আমি কি কাঁদছি? এই তোড়ের মতো জলের ভেতর বুঝতেও পারছিনা ছাই। বইয়ে পড়া বিষুব অঞ্চলে কি এরকমই বৃষ্টি হয়?

মঞ্চের উপর সাবধানে তোলা হোলো আমাকে। অত:পর হাত পা বেঁধে হেঁটমুন্ড করে শুইয়ে দেওয়া হোলো। আমার দৃষ্টিপথে এখন আর বিশেষ কিছুই আসছেনা। কানেও প্রবেশ করছেনা কোন উল্লাস,বক্তৃতা কিম্বা ড্রামবাদন যা কিনা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ঠিক আগের মুহূর্ত অব্দি বাজানো হতে থাকে। শুধু বৃষ্টির শব্দ। তাই কি? কোথা থেকে যেন গরুর গলাতে বাঁধা ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। বাবার উঁচু গলায় হাসিও যেন কানে এলো ( আহা,,তিনি কি খবর পেয়েছেন)। খুব ভোরে ভেসে আসা পাখির ডাক,কনভেন্টের মাদাম সুপিরিয়রের জুতোর ঠকঠক- সব মিলে মিশে খুব সুন্দর এক শব্দলহরী। আমি তার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে চোখ তুলে সামনের দিকে একবার তাকালাম। মুক্তির দেবী তার উন্নত চোখ আর মাণদন্ড হাতে নিয়ে যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তার কন্ঠে দৃপ্ত সঙ্গীত -

 Amour sacré de la patrie,
Conduis, soutiens nos bras vengeurs !
Liberté, Liberté chérie,
Combats avec tes défenseurs !

 আগুয়ান হও বন্ধু!!

পিতৃভূমির প্রেমে দৃঢ় হোক তোমার দু হাত!

একতা ও ভালোবাসাময় এই পতাকার নীচে

মুক্তি,মুক্তি - আহা পাই যেন মুক্তির স্বাদ!!!


আমি পরম শান্তিতে চোখ বুজলাম।






শীতলপুরের ঠিকানা




শীতলপুর খুব দূরে নয়। আবার খুব কাছেও নয়। আমি অনেকদিন আগে ওখানে গেছি , তেমনটা বলা যায়না। আবার গতকালই ঘুরে এলাম বললেও ভুল হবে। ওই গ্রামটা আছে কোথাও,কখনো না কখনো ওখানে আমরা কেউ না কেউ নিশ্চই গেছি।

শীতলপুরে ছোট ছোট মাটির বাড়ি আছে। সেগুলোর উঠোন নিকোনো। সেখানে বৃষ্টির সময়ে ছাগল আর মুরগী আশ্রয় নেয়। শীতকালে তারা ওখানেই রোদ পোয়ায়। পোষা কুকুরটা দাওয়ার নীচে বসে চোখ বুজে ঝিমোয়। সন্ধেবেলায়  উনুনের ধোঁয়া হাল্কা ভেসে থাকে। গ্রামের চৌমাথায় মুদির দোকানে বুড়োরা জমায়েত হয়। একটু দূরে বাঁশ ঝাড়ে ছেলে ছোকরার দল বাংলা নিয়ে বসে। এ অঞ্চলে মদ খাওয়া নিয়ে খুব একটা বাধ্য বাধকতা নেই। গ্রামে মোটরবাইক ঢোকে ভটভট করতে। চালের আড়তদার কিম্বা মুদি দোকানের সাপ্লায়ার। গ্রাম শেষ হবার মুখে একটা পুকুর রয়েছে,সেখানে বৌ ঝি রা কাপড় কাচে বাসন মাজে। গ্রামের চারিদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া জঙ্গলে রাত নামে জোনাকীর ডানায় সওয়ার হয়ে। কুটুরে প্যাঁচার ডাক শোনা যায়।

গ্রাম থেকে বেরিয়ে, বাইকে করে পাঁচ মিনিটের রাস্তায় একটা ছোট্ট টিলা আছে। তার ওপরে উঠতে তোমার হাঁপ ধরবে না,যদি না চিপ্স খাওয়া বদন হয়। পাথুরে টিলা। এখানে ওখানে ঝোপঝাড় নয়তো স্রেফ ন্যাড়া পাথর সম্বল। গ্রামের বাচ্চাগুলোর কাছে এই টিলাটাই হোলো খেলার জায়গা। তারা এর মাথায় চড়ে, আবার অন্যদিকে গিয়ে নামে। টিলার ওপরে কারা এক গাদা ইঁট রেখে গেছিলো কখনো। সেগুলো ঢেলা হয়ে গেছে। টিলার মাথা থেকে তারা সেই ঢেলা ছোঁড়ে। অনেক অনেক দূর উঁচুনিচু ডাঙার দিকে তারা তাকিয়ে থাকে, হয়তো সেদিক থেকে ওদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলো। সূর্য ডুবুডুবু হলে ছেলেগুলো ঘরের পথ ধরে। তাদের মা রা শাঁখ বাজিয়ে ডাকে : ঘরে আয়ায়ায়ায়। এই টিলাটার কোন নাম নেই। হয়তো ছিলো কোনদিন, এখন সবাই ভুলে গেছে।

টিলাটার পায়ের নীচে একটা ডোবা আছে। সেখানে শালুক টালুক ফোটে। ব্যাঙ ডাকে বর্ষায়। ডাহুক চরে। ডোবাটা শীতকালে প্রায় শুকিয়ে যায়। তার নাবাল বুকে জন্মায় শীতালু ঘাস। সাপের খোলস পড়ে থাকে তার পাশে।

টিলাটার মাথায় তিনটে গাছ রয়েছে। বেঁটে বেঁটে বয়স্ক গাছ। ডেঁয়ো পিঁপড়ের দল এ গাছে ও গাছে চরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে পায়রা কিম্বা কাক শালিক এসে ডালের ওপর বসে। গাছগুলোর শিকড় এঁকেবেঁকে শিলার গর্ভে ঢুকে গেছে পোক্তভাবে। কোন ঝড় ওদের কিচ্ছু করতে পারবেনা। অবশ্য বাজ পড়লে আলাদা কথা। তিনটে গাছ তিনজন বন্ধুর মতো চুপ করে একে অন্যের সুখ দু:খ আর ডেঁয়ো পিঁপড়ে ভাগ করে নেয়।

এই টিলা,তার মাথায় গাছ, বাচ্চাগুলো আর শীতলপুর - এই সবকিছুর ছবি তুলেছিলাম। আজকে ফিরে দেখি সেগুলো সব সাদা হয়ে গেছে। শীতলপুর তাই আছে,আবার নেইও। সেখানে ফেরা যেতেও পারে,বা " ফিরবো" বলা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে এক লহমায়। একটা ভাঙা সাইকেল চড়ে আবার ওই টিলার নীচের ছোট্ট ডোবাটার ধারে বসে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে শোনা যেতে পারে গরুর গাড়ির টুংটাং, যখন সে ধান নিয়ে আল রাস্তা ধরে অনেক দূর চলে যায়। অথবা সবশুদ্ধ মিলে ভোজবাজির মতো হাপিসও হয়ে যেতে পারে।

আমাকে তাই শীতলপুরের ঠিকানা জিজ্ঞেস কোরো না।

স্বপ্নের আবার ঠিকানা হয় নাকি?

নাত্থুরামের ভেড়া


      *** নাত্থুরামের ভেড়া ****

নাত্থুরামের সাথে আমার আলাপ হয়েছিলো একটা অসমান প্রান্তরের ওপর। এই প্রান্তর চিরে গেছে রাস্তা। তার ওপর দিয়ে দিনে তিন বার বাস যায় শহরের দিকে। আমি শেষ বাস ধরবো বলে একদিন পাঁচটা নাগাদ দাঁড়িয়ে ছিলাম একটা চাল গুদামের পাশে। মিস করে গেলে আজ এ অঞ্চলেই বডি ফেলতে হবে। বাস লেট করছে। অসমান এই প্রান্তরের ওপর দিয়ে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে জোলো হাওয়া। এখন বর্ষাকাল। আমার সামনেই মাইলের পর মাইল  উঁচু নীচু ডাঙা ঢাল বেয়ে ক্রমে দিগন্তে মিশেছে।  চাষআবাদ বিশেষ হয় না এই পাথুরে মাটিতে, তবে এ বছর বর্ষা ভালো হওয়াতে ফসল লাগানো হয়েছে। যে জমিতে ফসল নেই,সেখানে গরু ছাগল চরছে তাজা ঘাস খাওয়ার লোভে। পশুচারনের জন্য এ অঞ্চল বিখ্যাত। আর চরছে ভেড়া। সেই মেষপালের দিকে তাকিয়ে আছে নাত্থুরাম। ভেড়াগুলো নাত্থুরামের।

বেলার দিকে ঝেঁপে বৃষ্টি হয়ে আকাশে এখন এক কনাও ধুলো নেই। সেই জন্য দূরে নীল রঙের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে ওই পাহাড় বহু বহু দূর। রোজ দেখা যায়না তাই। আকাশে মেঘ রয়েছে । মাঝে মাঝে গুম গুম করে আওয়াজ ভেসে আসছে। " এ কি গভীর বাণী এলো ঘন মেঘের আড়াল থেকে। " রাতে আবার ঝরাতে পারে। বাস লেট করছে। আমি উসখুস করছি।

- কাঁহাতক জায়োগে বাবু?

আমার থেকে হাত বিশেক দূরে নাত্থুরাম  উবু হয়ে বসেছিলো। গায়ের রঙ পাকা ব্রোঞ্জ , পরনে খেটো ধুতি, হাতে বাঁশের লাঠি, মুখে বিড়ি, চোখের দৃষ্টি স্থির। পাকানো স্বাস্থ্য।

আমি গন্তব্য বললাম। নাত্থুরাম আমার দিকে না তাকিয়েই বললো - পয়েদল কিতনা টাইম লাগে গা?

ওকে বল্লাম যে আমি কখনো চেষ্টা করে দেখিনি পায়ে হেঁটে যাবার।

নাত্থুরাম ভেড়াগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো - ইয়ে সব লেকর হাম চলতে হ্যায়।

- কাঁহা?

- বস,চলতে হ্যাঁয়,,,,

নাত্থুরামের ভেড়াগুলো তখন ঘাস খাচ্ছিলো। বিকেলবেলার সূর্য, রশ্মি ফেলছিলো তাদের গায়ে। আমাদের কোলকাতায় দেখা গোলাপী দাগ মারা মাল নয় এগুলো। এদের লোমগুলো বেশ পশমী আর লম্বা লম্বা ল্যাজ। ভেড়াদের এমন লম্বা ল্যাজ আমি দেখিনি। ভেড়া, কিন্ত ভেড়া নয় টাইপের।

- এগুলো কি কুরবানীর ভেড়া?

নাত্থুরাম হাসলো।

- দুনিয়াদারীর কিছুই জানেন না দেখছি।

ভেড়ার সাথে দুনিয়াদারীর কি সম্বন্ধ বুঝলাম না।

নিজের কম্বলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বললো - ধরে দেখুন এটাকে।

আমি সন্তর্পনে হাতে নিলাম। ভেবেছিলাম বিচ্ছিরি কুটকুটে আর ঘেমো গন্ধওয়ালা পদার্থ হবে। কিন্ত দেখা গেলো মোটেই তা নয়!! দিব্যি তুলতুলে নরম। খানদানী জিনিস মনে হচ্ছে।

- এই কম্বল তৈরি হয়েছে ওদের গা থেকে।

নাত্থুরাম গর্বিত ভাবে বিড়ি ধরালো।

আমি বেশ সম্ভ্রম নিয়ে একবার ভেড়াগুলোর দিকে আর একবার নাত্থুরামের দিকে তাকালাম। নিজের ভেড়ার লোম থেকে তৈরি কম্বল পরে যে মানুষ তার থেকে ভাগ্যবান আর কে আছে।

- ভেড়ার পাল নিয়েই আমাদের জীবন বাবু। আমি,আর আমার দুটো ছেলে বেরিয়েছি শ্রাবণের প্রথম হপ্তায়। ভেড়া ঘাস খাচ্ছে।ভেড়ার পশম আরো মোলায়েম হচ্ছে। এই পশম বেচে আমাদের সংসার।

- সেই সংসারে কে থাকে?

আমি নাত্থুরামের পাশে একটা জেগে থাকা পাথরের ওপর বসলাম। বাস লেট করছে।

- আমার আওরৎ আছে। ছেলেদুটোর বিয়ে শাদী দিলাম। ওরাও বেরোবে ধান কাটাইয়ের সময়।

- তোমার ছেলেগুলো কই?

নাত্থুরাম অনির্দিষ্ট ভাবে দূরে প্রান্তরের দিকে আঙুল দেখায়।

- পালের সঙ্গে আছে কোথাও।

সন্ধে নামছে বর্ষাপীড়িত চরাচরের ওপর। ঝিঁঝিপোকার ডাক তীব্রতর হচ্ছে। ওরা বাড়ি ফিরবে না?

- আজকে এখানেই থেমেছি। তিনদিন ধরে হাঁটার পরে। এর আগে থেমেছিলাম রামগড়ের আগে। তার আগে হাজারিবাগ,তার আগে দুমকা...।

- তোমরা আসছো কোথা থেকে?

নাত্থুরাম নিরুত্তর থাকে।

- বড়জোড়া অব্দি যাবার আছে। ওখানে ইয়াব্বড় হাট বসে পশমী ভেড়ার।

আমি আকাশ পাতাল ভেবেও এরকম কোন হাটের কথা মনে করতে পারলাম না। শহুরে মানুষ। শোনপুরের মেলা জানি। পুষ্করের মেলা জানি। কিন্ত বড়জোড়ার ভেড়ার মেলা?

আমার ভ্রু কুঞ্চন দেখে নাত্থুরাম হাসে।

- ওসব শহুরে লোকদের জায়গা নয় বাবু।

গা শিরশির করে। কোন অজানা দেশের লোক এরা?

কম্বলটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে নাত্থুরাম বললো - এসব আমরা নিজেদের জন্য করি বাবু। বিক্রির মাল নয়। আজকালকার মেয়েগুলো অবশ্য এসব তেমন করতে পারেনা। এটা আমার মায়ের তৈরি।

ওর চোখের দৃষ্টি আবিল হয়। কম্বলের ওমে মায়ের স্নেহ জেগে থাকে যাযাবরের কাছে।

- দুইদিন এখানে থাকবো। তারপর ফের হাঁটা। বেশীদিন কোথাও থাকিনা একভাবে। থানা পুলিশের ঝামেলা শুরু হয়। এখানে এলে তখন আর একটা ভেড়ার লোমও দেখতে পাবেন না। হ:।

- তোমরা রাত্তিরবেলা থাকো কোথায়?

- পালের কাছেই তো থাকতে হয়। রাত্তিরে হুড়ার আসে। তাই পাহারা দিতে হয়। ওই শুয়ে পড়ি...। তাঁবু থাকে সাথে।

দুজনে পাশাপাশি বসে আছি কিন্ত মনে হয় মাঝখানে দুস্তর ব্যবধান। এইসময়ে দূরে বাসের আলো দেখা যায়। আমি ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়ি। নাত্থুরাম ভেড়াগুলোকে " হ্যাট হ্যাট " করে যাতে কেউ বাসের সামনে চলে না আসে হঠাত। ভেড়াগুলো শান্তমনে ঘাস খেতে থাকে। সবুজ প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকে সফেদ পশম।

- আয়াচ্ছা।

আমি হাত দেখাই। নাত্থুরাম লাঠি উঁচু করে। ওই লাঠি দিয়েই ওরা হুড়ার তাড়ায়। খুঁটিতে বাঁধা মানুষ দেখলে তাদেরও হয়তো তাড়ায়।

বাসের আলোয় ভেড়ার পাল আর নাত্থুরাম ভেসে ওঠে একবার, ফের ঝাপসা হয়ে যায় অতীতের মতো। প্রান্তর পেছনে পড়ে থাকে। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয় যায় সেদিন। রাতে আবার বৃষ্টি নামে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নাত্থুরামের কথা ভাবি। ভেড়ার পাল নিয়ে এই ঘোর বৃষ্টিতে সে হুড়ার তাড়াচ্ছে। তার কাঁধে মায়ের দেওয়া কম্বল।

ওর নাম নাত্থুরাম নয়। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করিনি।

তারার আলোয় পথ চলা মানুষদের কি নাম জিজ্ঞেস করতে আছে?