বিভিন্ন ভার্চুয়াল, এবং মুখোমুখি আড্ডায় বন্ধুরা মাঝেমধ্যেই কিশোর ও প্রাক কৈশোর বেলার গল্প লেখার দাবী করেছে, ও করছে। সেই সমস্ত ঘটনার তারা যৌথ সাক্ষী,এবং বহু আসরে আমাদের সেই সুখী ঘোঁতঘোঁত অন্যান্য গল্পগাছাকে বীরদর্পে থামিয়ে দিয়েছে।
বেশ,হোক শুরু। তবে মাথায় রাখতে হবে,যে এর মধ্যে এমন অনেক ঘটনাও থাকবে,যা অনেক বন্ধুই জানবে না,কারন বন্ধুত্ব স্কুলতুতো,কোচিংতুতো,ফ্ল্যাটতুতো, পাড়াতুতো ইত্যাদি নানা গোত্রের হতে পারে কিনা,তাই।
যাদের গপ্পো বলা হবে তারা সকলেই বাস্তব চরিত্র এবং ঘটনা গুলিও ঘোর বাস্তব। সুতরাং যেকোনো রকম মিল সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে,যে কারুর কাছে কোন দু:খপ্রকাশ করার দায় নেই আমার।
বন্ধু চল ১
মিশন শান্তিনিকেতন
এ হলো সেই সময়ের কথা,যখন আমরা স্কুল লাইফের বাধোবাধো ভাব ছেড়ে কলেজ জীবনের উদ্দামতায় ঢুকে পড়ে নিজেদের যথোচিত লায়েক মনে করছি। যদিও সত্যি হলো,যে বিদ্যালয় জীবনের ভীরুতা গা থেকে তখনো খসে পড়েনি - অর্থাৎ ফার্স্ট ইয়ার। ঠিক এই কারনেই বেড়াতে যাবার প্ল্যান করার সময়ে সবার আগে মনে পড়ে গেছে স্কুলে পড়া আর কোচিং বন্ধুদের,যাদের হয়তো কলেজ আলাদা কিন্ত স্কুল বন্ধুত্ব অটুট। আমাদের পকেট তখন নিউটাউন action plan 3- অর্থাৎ ইতিউতি ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স হলেও অধিকাংশই ফাঁকা মাঠ। কিন্ত মেজাজটাই তো আসল রাজা - তাই টাকাকড়ি কম থাকলেও ডোন্ট কেয়ার।
ক্রীশমাসের ছুটি। কোথাও বেড়াতে না যাওয়াটা একটা পাপ। কিন্ত একইসাথে দৃশ্যসুখ আর পকেটের সুখ উপভোগ করা যেতে পারে এমন কোন জায়গা আছে কি? সিগারেট কিনতে দশ কিলোমিটার ঠ্যাঙাতেও হবেনা,আবার গায়ে ঘষটানো ভীড় ঠেলতেও হবে না সারাক্ষণ,এই জাতীয় কোন মোকাম? ভাবনাচিন্তা করে দেখা গেলো : আছে আছে স্থান!! সেখানে পৌষমেলার মোচ্ছব। সেখানে বিদুষী মামনিদের হাট। সঙ্গে ফাউ হিসেবে চনমনে ঠান্ডা আর খোলা আকাশ। বাবা তখন সদ্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, মানে থাকার খরচা নেই। সেবারের ছুটিতে তাই ঠিক হলো, যে বাঙালী সংস্কৃতির এই মদিনায় আমাদের দিগ্বিজয় সাধিত হবে।এরপরে আর কি? "আয়ায়ায়া আমাদের শান্তিনিকেতন" বলে নাচতে নাচতে ট্রেনে উঠে পড়ার শুধু অপেক্ষা।
( আমার কেন জানি না বহুদিন ধারনা ছিলো যে এই গানটা তোতলাদের জন্য লেখা, যাতে ফার্স্ট লাইনে আটকে গেলে সেটা ম্যানেজ করা যায়)।। আমি দুদিন আগে চলে গেছি বাবা মায়ের সাথে। বন্ধু ব্রিগেড আসবে আমার পিছু পিছু। নামবে প্রান্তিকে ( বোলপুরের পরের স্টেশন) কারন সেখান থেকে ফ্ল্যাট চত্বর হাঁটা পথ। জনা ছয়েক সদ্য ভোটাধিকারপ্রাপ্ত অত:পর দিন দুয়েক বাবা মা সম্মিলনে ভদ্রসভ্য থেকে, তাঁরা কলকাতা প্রস্থান করলেই নিজমূর্তি ধারন করবে। সমস্ত পরিকল্পনা ঠিকঠাক, কিন্ত হায়। রবিঠাকুরের ঠেক যে শুরু থেকেই তাদের প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করবে, সে কি কেউ ভাবতে পেরেছিলো আগে?
বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার যখন প্রান্তিক স্টেশনের হাতায় এসে দাঁড়ালো, শীতালি রোদ্দুর সবে ছোট্ট কাঁচামাটির প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। আমি শাল মুড়ি দিয়ে বন্ধুদের অভ্যর্থনা করবো বলে দাঁড়িয়ে। বীরদর্পে একে একে নামলেন তারা। অনির্বাণ, সন্দীপ,শান্তনু, সৌম্য,বান্টি এবং মৈনাক। সকলের মুখেই চওড়া হাসি,আমিও বেশ একটা রাশভারী হোস্ট ভাব নিয়ে " আয়,আয় কোন কষ্ট হয়নি তো" ভাব করে এগিয়ে গেছি - এমন সময়ে মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন একটি কালো কোট।
বোঝা উচিত ছিলো। অবশ্যই বোঝা উচিত ছিলো বন্ধুদের,যে বোলপুর অব্দি টিকিট কেটে প্রান্তিকে নামা একটা রিস্ক ফ্যাক্টর। আমারও সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিলো,যে মেলার সিজনে জায়গাটা এক্কেবারে ক্ষুধার্ত হায়নায় ভরে আছে,কারন বহু লোক টিকিট না কেটে এই প্রান্তিকেই নামছে আশ্রমের দূরত্ব যেহেতু এদিক দিয়ে কম। কিন্ত ওই যে - ফার্স্ট ইয়ার।
বন্ধুরা অবশ্য তখনো অকুতোভয়। বুক ফুলিয়ে এগিয়ে দেওয়া হলো টিকিটের তাড়া। কালো কোট তার উপরে একবার তাকালেন। চোখে মুখে ফুটে উঠলো কেমন একটা কসাই কসাই ভাব। তারপর সেই টিকিটের থেকে ক্রুর দৃষ্টি তুলে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন : এ তো বোলপুর অব্দি কাটা আছে। তোমরা তো বোলপুর ছাড়িয়ে এসেছো।
বন্ধুদের মাথায় ব্যাপারটা তখনো, যাকে বলে register করেনি। কিন্ত আমি বুঝেছি। এবং সেই সাথে এটাও বুঝেছি, যে বিনা প্ল্যাটফর্ম টিকিটে ঘোরাঘুরি করছি বলে আমাকেও পাকড়াও করা হতে পারে। তাই " শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ" পোজে একটু সাইডে সরে গেলাম।
কালো কোট আর সময় নষ্ট না করে বললেন : একশো পঁচিশ টাকা।
বন্ধুদের মধ্যে "স্মার্টবয়" অনির্বাণ( সেই একমাত্র ফ্রেঞ্চকাট রাখার স্তরে উন্নীত হয়েছে,বাকী সবার তখনো স্কুলকালীন সেই বন্য গোঁফ সম্বল) পালটা ভাও দেখিয়ে " আপনি রসিদ কাটুন, আমরা দিয়ে দিচ্ছি " গোছের একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কালো কোট মেসির মতো নৈপুণ্যে তার কনফিডেন্সকে ডজ করে জালে বল ঢুকিয়ে দিয়ে বললো :
"একশো পঁচিশ। each. "
আগামী সাতদিনের জন্য তখন প্রত্যেকের পকেটে বরাদ্দ তিনশোটি টাকা। তার মধ্যে খাওয়াদাওয়া আছে, সিগারেট আছে,ঢুকুঢুকুর প্ল্যান আছে,ভ্যান বা রিক্সাভাড়া আছে এবং ফেরার টিকিট কাটতে হবে সেই টাকা থেকেই। এখন পকেট থেকে একশো পঁচিশ বেরিয়ে গেলে ঢুকুঢুকু এবং অন্যান্য বিলাস তো দুরস্থান, শেষ দুদিন হয়তো না খেয়েই...!!!
কালো কোট তখন বন্ধুদের চোখে মোটামুটি ভারতভাগ্যবিধাতা। অতএব প্রায় সমবেত আর্তনাদ সহকারে তার উদ্দেশে আকুল প্রার্থনা আর অনুনয় বিনয়ের বন্যা বয়ে গেলো। এর ফলে তিনি যে কয়েকটি তাজা কিশোরের অনাহারে মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন, সেটাও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হলো একইসাথে। কালোকোট অবশ্য হীরক রাজার মতো নিষ্ঠুর নন, যে বলে উঠবেন : অনাহারে নাহি খেদ/ বেশী খেলে বাড়ে মেদ। তাছাড়া তিনি এটাও বুঝতে পারলেন, যে এই ছেলেগুলির থেকে খুব বেশী টাকা বের করা,আর দাউদ ইব্রাহিমকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রায় একই লেভেলের উদ্যোগ। অতএব যথোচিত কাঠিন্যে শুধু একজনের ফাইনের টাকা অর্থাৎ একশো পঁচিশ নিয়েই তিনি আমাদের রেহাই দিলেন। সবাই মনের মধ্যে অল্পবিস্তর মেঘ নিয়ে স্টেশন ছাড়লো। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেটা কেটে যেতে অবশ্য বেশী সময় লাগলোনা। ইতিমধ্যে আমরা দুটি প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি।
এক :যাই হোক আর তাই হোক - রিক্সা কিম্বা ভ্যান চড়া চলবেনা। পুরোটাই পা গাড়ির উপর ভরসা রেখে এগোতে হবে, সে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন।
দুই : সিগারেট খাওয়ার বিলাসিতা পরিহার করো। ফিরে এসো দেশজ শিল্পে, অর্থাৎ বিড়িতে। যার কাছে যা অবশিষ্ট সিগারেট আছে খরচ হলেই আমরা " কোন পুরাতন প্রানের টানে" গাইতে গাইতে বিড়িতে টান দেবো।
কোন ব্র্যান্ডের বিড়ি সবচেয়ে সরেস,সেই নিয়ে উচ্চাঙ্গের আলোচনা হতে হতে ( এই ব্যাপারে দু একজনকে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ দেখা গেলো,মানে আন্তর্জাতিক বিড়ি সম্মেলনে তারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেই পারে) কখন যে ফ্ল্যাটের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছি খেয়ালই নেই। এখন থেকে আমরা একেকটি আদর্শ ছাত্রের প্রতিমুখ। প্রথমেই একটি বাওয়ালের ঝাপ্টা কাটিয়ে উঠে আমরা তখন আশা করছি যে সামনে শুধুই বিশুদ্ধ ফুর্তির দিন।
কিন্ত তখন কি জানতাম, যে কত অন্ধকার এবং আলো অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য?
গুরুদেবের দেশে আমাদের পরবর্তী কীর্তিকলাপ বলবার আগে এটা জেনে নেওয়া ভাল,যে এত্তগুলো ছেলের থাকার ঠাঁই কি ভাবে হয়েছিলো।
আগেই বলেছি, বাবা প্রান্তিকের কাছে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। বেঙ্গল পিয়ারলেসের করা " সোনার তরী " নামের আবাসনের প্রান্তদেশে এক বেডরুমের তিনতলা। পজিশন দুর্দান্ত, কারন সামনেই আবাসনের পাঁচীল,তার ওপারে লালমাটি চিরে চলে গেছে একটি জলধারা। সেখানে ছেঁড়াখোঁড়া জঙ্গল। রাখাল গরু, ছাগল চরাতে আসে। খালের ওপারে সীমান্তপল্লীর ছায়াঢাকা গ্রাম। ছাদে উঠলে বাঁদিকে তাকালে প্রাচীন রেলব্রীজ,যেখান দিয়ে ট্রেন যায় হাতছানি দিয়ে। ডানদিকে তাকালে সরু পীচ রাস্তা বাঁক নিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। ওই রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই সোনাঝুরির জঙ্গল,অর্থাৎ খোয়াইয়ের ধার।
এই কাব্যিক পরিবেশের মধ্যে সাত সাতটি খোক্কসের উদয় হওয়ার পরে যা হবার তাই হয়েছে। দুপুরবেলা কাছেই একটা খাবার জায়গায় একপেট করে গেলার পর সেই রেস্টুরেন্টের লোকেরা তালাচাবি লাগিয়ে চলে গেছে। শান্ত নিস্তব্ধ আবাসনে কাওতালি আর হররার চোটে লোকাল কাক শালিকেরা কেটে পড়েছে।এবং কোন ফ্ল্যাটের কোন তলায় কি ধরনের ললনা বিরাজ করছেন, তৈরি হয়ে গেছে সেই ম্যাপ।
যাই হোক, যে প্রসঙ্গে এত কথার ত্যানা প্যাঁচানো। সাতটা দামড়া ছেলের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটের মধ্যে আরামসে থাকার রহস্য এবার খোলসা করি।
হিসাবটা খুব সোজা।
১) ঘরে মিনিমাম সময়ের উপস্থিতি। সারাদিন বাইরে টো টো করে ঘুরে হাল্লাত হয়ে বাড়িতে এসে,আবার দু ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে যাওয়া। শীতের শান্তিনিকেতনে চার দেওয়ালের মধ্যে যে থাকে তার চেয়ে দুর্ভাগা কেউ হতেই পারেনা। আমরা তেমন নই,তাই হরবখত ফ্ল্যাটে গরুর হাটের হট্টগোলও নেই।
২) শোয়ার জন্য বারোয়ারি বিছানা।
একটা লম্বালম্বি গদি। তার ওপর পরপর বালিশ। ধুমশো একটা কম্বল। শুয়ে পড়ো এবার। কার বালিশ কোন মাথায়,কার ঠ্যাঙ কোনদিকে ,সব গুলিয়ে একাকার। এভাবেই জড়াপুটলি করে খিকখিক খৌ খৌ করে রাত কাবার হয়ে যেতো।এখন তিন চার বা পাঁচতারা হোটেলের বাসিন্দাদের সেইসব যৌথশয়ন মনে আছে কিনা,কে জানে?
আমাদের এই অভিযানের দ্বিতীয় কিস্তিতে নায়ক যদি কেউ থেকে থাকে, তো বান্টিসোনা ওরফে সুমিত। সেই গল্পটাই বলবো এবারে।
কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরার কারনে সকলেই কম বেশী ক্লান্ত সেদিন। দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে একে একে লম্বা হওয়া গেলো ফরাসের ওপর। একটু খানি গড়িয়ে নিয়ে চরতে বেরোনো হবে। বাবা মা বেডরুমে আছেন,আমরা সব বাইরের হলঘরে অধিষ্ঠিত। আমাদের মধ্যে দু তিনজন ভালোমতো সিগারেট খোর হয়ে উঠেছে ফার্স্ট ইয়ারেই,সুতরাং তারা শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে সিগারেটে সুখটান দিয়ে চাদরের তলায় ঢুকেছে।
শীতের বেলা দেখতে দেখতে ঢলে পড়ে। সেদিন পরিকল্পনা ছিলো খোয়াইয়ের হাটে যাওয়ার। সেইমতো আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়েছি। চাদরের তলায় সিগারেটের প্যাকেট লুকানো আছে। বাবা এক্ষুনি বেরোবেন ঘর থেকে। তাই সব ধামাচাপা দিয়ে ভালোমানুষের মতো সবাই ফরাসের উপরে বসে। মধ্যমনি হয়ে বান্টি। বাবা বেরোলেন। আমাদের পরিকল্পনা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম। মৈনাক তখনো নাক ডাকছিলো। লোকজনের গলার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙবো ভাঙবো অবস্থায় আসায়, সে একটা " ঘোঁত " আওয়াজ করে পাশ ফিরলো,সঙ্গে চাদরটাও নিজের গায়ের ওপর জড়িয়ে নিলো অক্লেশে। আমাদের যাবতীয় গোপনীয়তা উন্মুক্ত করে সিল্ক কাটের প্যাকেটটা জ্বলজ্বল করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। ঠিক বান্টির সামনে। বাবা সেদিকে তাকালেন। আমরা সেদিকে তাকালাম। বান্টি এক গাল হাসি নিয়ে তাকালোনা। এইজন্যেই ওকে বান্টিসোনা বলে ডাকা হোত। বাবা হাসলেন। বেরিয়ে গেলেন। আমরাও হাসিতে ফেটে পড়লাম। বান্টি এবারে সেদিকে তাকালো। ওর হাসি নিভে গেলো।
কিন্ত এতেই যদি বান্টির ভোগান্তি শেষ হতো, তাহলে আমি ছেলেটাকে এ পর্বের নায়ক করতাম না।
কিছুক্ষন পর। আমরা বেরিয়ে পড়েছি হাটের উদ্দেশ্যে। ফ্ল্যাট থেকে হাট চত্বরে পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট কুড়ি মতো। পা গাড়ি চলছে বনবন। বেলা ঢলে পড়েছে, আর শিরশিরে একটা হাওয়া ভেসে আসছে খালের উপর দিয়ে। আমি,সন্দীপ,মৈনাক এবং সৌম্য ধোঁয়ার উত্তাপে সেই ঠান্ডাকে সরিয়ে দিচ্ছি। বান্টি খাবেনা। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন,অর্থাৎ দলে এতগুলো ফুঁকো থাকা সত্বেও সে কেস খেলো কেন, এই অভিমানে " দাম দিয়ে যন্ত্রনা" কে সে দূরে সরিয়ে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রাম্য চৌরাস্তায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। এই মোড়ের বাঁদিকে দশ মিনিট হাঁটলে আশ্রম,ডানদিকে গোয়ালপাড়া গ্রাম, সোজা হাঁটলেই সোনাঝুরির জঙ্গল তথা খোয়াইয়ের হাট। অনেক সাধ্য সাধনার পরে বান্টি রাজি হলো সিগারেটে চুম্বন দিতে। শীত আরো জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে হাতে সিগারেট না থাকলে ঠান্ডা কাটবে কি করে?
আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের ফোঁকা শেষ। এখন শুধু বান্টির মুখে ধোঁয়া। সুখটান। প্যাঁক প্যাঁক শব্দে রিক্সার ঝাঁক আসছে যাচ্ছে। হাটুরে লোকেরা ঘোরাঘুরি করছে। ছাগল ছানা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে,পেছনে ন্যাংটো খোকা ততোধিক লাফাচ্ছে। রাস্তার ধারে দোকানে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। ডিমভাজার গন্ধ। বান্টির মেজাজ শরীফ। এখান থেকেই আমরা মেলায় যাবো। সেখানে কি কি হতে পারে আর না পারে সেই নিয়ে সবাই উত্তেজিত। দূর থেকে একটা রিক্সা আসছে। বান্টির মুখে আবার সেই ভুবনভোলানো হাসি ফিরে এসেছে। রিক্সা আরো কাছে চলে এসেছে। বান্টির মুখে সিগারেটের কমলা সুখ। রিক্সার উপরে বাবা।
বাবুরা এবং বিবিরা - এইবারে ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে আস্তে আস্তে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপার স্যাপার উঁকি মারতে শুরু করবে । সেই জন্যআগেই "U/A" মার্কা বোর্ড টাঙিয়ে দিলাম। একটু বুঝেশুনে দরজা খুলবেন।
সকাল। শীত। কুয়াশা। শিশির।
বাবা মা ভোরের ট্রেনে কলকাতার দিকে ফিরতি পথ ধরেছেন। কোনক্রমে তাদের দরজা খুলে দিয়ে আমি আবার ফরাসের উপর লম্বা হয়েছি। চোখে ঘুম নেমেছে সাড়ে তিনটের পর। আয়ায়ায়াহ..ধুত্তেরি!!! হতভাগা শান্তনুর দামড়া লাশটাকে পাশবালিশ ভেবে জড়াতে যাচ্ছিলাম। সে ঘুমের মধ্যেই একটা কাঁচা ছাড়লো। সারারাত হ্যা হ্যা করে দাঁত কেলিয়ে এখন ব্যাটা নাক ডাকাচ্ছে। কিক্কেলো রে বাবা। প্রায় মমি পোজে খানিকক্ষন শোয়ার চেষ্টা করলাম। ধুসসসস।
কটা বাজে এখন? ঘড়ি জানালার তাকে। সৌম্যকে খোঁচা দেওয়া যাক একটা। শালা মরে গেলো নাকি!!!
- ইরিবাবায়ায়া। কি ঠান্ডা!!! শালা এ শান্তিনিকেতন না দার্জিলিং।
বলতে বলতে সন্দীপ উঠে পড়লো। আমি এক দৌড়ে বাথরুমে।পটি পটি ভাব হচ্ছে একটা। এইসব মালেরা একবার উঠে পড়লে বাথ্রুমে যাওয়া ভোগে। ন্যাট জিয়োতে কুমীরের বাসায় ডিম থেকে বাচ্চা বেরোনো দেখেছেন কখনো? পাঁচ মিনিটের মধ্যে একে একে সবাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে এবার,ঠিক সেই স্টাইলে। প্রায় একসাথেই। সেইসময়ে আমরা শোয়া বসা খাওয়া ঘুম প্রায় যৌথ ভাবেই পালন করতাম কিনা।
ফ্রেস হয় যখন বেরোলাম, জনতা তার মধ্যে হেবি চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। অনির্বান ভেতরের ঘরের বিছানায় আবার লম্বা হয়েছে,আর সবচেয়ে মোলায়েম বালিশটা দখল করেছে। বান্টি সেই বালিশ টানাটানি করছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সংসারী সন্দীপ গম্ভীর মুখে চায়ের জল চাপাচ্ছে। মৈনাক আর সৌম্য কালকে কেনা একটা বিড়ির প্যাকেট থেকে দু পিস বার করে তরিবত করে টানছে আর মাঝে মাঝেই জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে বলছে : শালা কি কষটা মাইরি। শান্তনু চূড়ান্তভাবে ফরাস আঁকড়ে ঘুমোচ্ছিল। সে যে কিভাবে পাঁচ পাঁচটা ডিফেন্ডারকে মারাদোনাসম ডজ করে বাথরুমে ঢুকে পড়লো,সে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য!!! কেউ কিছু বোঝার আগেই ধাঁই করে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, আর হেঁড়ে গলায় শোনা গেল গান : আরে চাঁন্দ সিতারে ফুল অর খুসবুউউউউ...।
- শালা খুসবু বলে টানটা দিচ্ছে দ্যাখ। ছাদ টাদ ভেঙে না পড়ে। " অনির্বান ঠ্যাঙ দোলাতে দোলাতে বললো।
- ওরে, কাল বারন করেছিলাম ডিম না খেতে। খুসবু তো দরজা ভেদ করে বেরোচ্ছে এবার।" সৌম্যর ফোড়ন।
সন্দীপ " চা গুলো নে, বেবুনের দল " বলে সবেমাত্র হাঁক পেড়েছে,ঠিক এমন সময়ে...।
কোত্থেকে যেন একটা রিনিরিনি হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে না? চুড়ির রুনুঠুনু? মধুর পদসঞ্চার?
আমরা সবাই দুদ্দাড়িয়ে জানালা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে,ঘরের দরজা খুলে দেখতে শুরু করলাম। সৌম্য আর না পেরে ছাদের দিকে চলে গেলো। আমাদের সেই বুভুক্ষু দশা দেখলে জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর গুলোও লজ্জা পেতো সেদিন। শান্তনু ততক্ষনে " হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ " গাইতে গাইতে গাইতে নিজেকে হৃতিক রোশন না হোক,রসুন অব্দি ভেবে ফেলেছে। অনির্বান তাকে তিন খিস্তি দিয়ে বললো : কাকায়ায়ায়া। মামনিইইইইই। চুউউপ। কাকা চুপ করলো আর তিন মিনিটের মাথায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে " কই, কই শুরু করলো। "
আমরা যখন এইভাবে দাপাদাপি করছি,সন্দীপ তার শকুনের চোখ দিয়ে খুঁজে বের করলো সেই এল ডোরাডো। আমাদের ফ্ল্যাট হচ্ছে টপ ফ্লোরে। সেই ফ্ল্যাটের বেডরুমের জানালার ঠিক নীচে একটা দোলনা। সেখানেই আবির্ভূতা হয়েছেন লাল সোয়েটার গোলাপী সোয়েটার পরে দুজন পরী ( পরে আবিষ্কার করা হয়েছিলো,এই দোলনাটি একইসাথে আনন্দ আর মাথাব্যথার জোগান দিতে পারে। প্রচুর রমণীয় কমনীয়দের মেলাও যেমন দেখেছি,গাদা বাচ্চাদের চ্যাঁ ভ্যাঁও সহ্য করতে হয়েছে)। আমরা জানালা দিয়ে একে আরেকজনকে টপকে তাদের দেখার চেষ্টা করছি,দেখি অনির্বাণ আর সন্দীপ ধড়াচূড়া পরে রেডি!!!! কি ব্যাপার?
- কোথায় যাচ্ছিস ভাই?
বান্টির সরল প্রশ্ন।
- যাইহ। মেয়ে গুলোর সাথে একটু আলাপ করে আসি। অনির্বান তুই কোনটাকে নিবি? সন্দীপ নিরাসক্ত ভাবে বললো।
আমরা তো পুরো হুব্বা!!! ইলেভেন টুয়েলভে স্কুল আর কোচিং এবং ফার্স্ট ইয়ার - এই হচ্ছে আমাদের মেয়ে চেনার দৌড়। নিজে থেকে যেচে কারো সাথে আলাপ করতে যাওয়া, অন্তত আমার কাছে,একটা অকল্পনীয় কেস ( সত্যি বলতে কি,আমি এখনো সেটা পারিনা। কেমন যেন জিভ শুকিয়ে যায়,হাত ঘামে আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ বের হয়। একবার একটি মেয়ে আমাকে retarded ভেবে অনেক সহানুভুতি দেখিয়ে ছিলো।)
অনির্বাণ দেঁতো হেসে বললো : কি রে, আর কেউ যাবি?
আমরা সবাই তখন বিশাল একেকজন আদর্শবাদী। " এইভাবে যেচে কারু সাথে আলাপ করিনা ", " মেয়ে গুলো হ্যাংলা ভাববে" থেকে শুরু করে বাঙলার যুব সমাজের অবক্ষয় নিয়ে একটা কঠিন ভাষণ শুরু করা যায় কিনা ভাবছি - সন্দীপ আর অনির্বাণ আমাদের আঙুর ফল টক আর নিতে না পেরে " তোরা বসে বসে ছেঁড় " বলে গটমটিয়ে নীচে নেমে গেলো। আমরা আবার গ্যালারীতে ফিরে এলাম। একটু পরেই দেখি গুটি গুটি দুই মক্কেল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটা হাবভাব যেন স্বর্গের উদ্যানে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে দুটো দেবদূতের বাচ্চা। মেয়ে দুটো ওদের দেখে কিছুটা সংযত। নীচ থেকেই শুনতে পাচ্ছি সন্দীপ বললো : গুড মর্নিং। দোলনায় বসে থাকা মেয়েটা প্রত্যুত্তর দিলো। আমরা ওপর থেকে খিক খিক করে হাসলাম।
নীচে কথাবার্তা চলছে। সন্দীপ নানা রকম বোলচাল দিচ্ছে। অনির্বানও কম যায়না। মেয়েগুলো কোন ফ্ল্যাটে উঠেছে থেকে শুরু করে বাড়িতে কে কে আছে, কোলকাতায় কোথায় থাকা হয়,কোথায় পড়া হয় ( সন্দীপ জেভিয়ার্সে পড়ে শুনে মেয়েদুটো খুবই ইম্প্রেসড। অনির্বাণও তাই জাভেরিয়ান হয়ে গেলো,যদিও সে টেকনোর পোলা)। বকবকমের মাঝে অনির্বাণ আঙুল দিয়ে আমাদের দেখালো, আমরাও হেঁ হেঁ করে হাত নাড়লাম। তারপর সন্দীপ হাল্কা করে কিছু একটা বলাতে মেয়েদুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।
- নির্ঘাত কান ভারী করছে। মৈনাক গরগর করে বললো।
- কি বলছে বলতো? সৌম্য উত্তেজিত ভাবে একটা বিড়ি ধরিয়েছে।
- বলছে নিশ্চয় আমরা সব আবোদা ছেলেপুলে, মেয়ে দেখলে প্যান্টে হিসু করে ফেলি।
- শালা শুয়োর।
শান্তনুর খেদোক্তি।
বান্টি চিন্তিত ভাবে বললো - এসব গপ্প দিলে তো মুশকিল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে তো মেয়ে গুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতেই পারবোনা।
- ওপর থেকে এক বালতি জল ঢেলে দিলে কেমন হয়? আমার সুচিন্তিত পরামর্শ।
- হে হে, তার চেয়ে সৌম্য, তুই বরং বিড়িটা সন্দীপের টাক বরাবর...
শান্তনুর কথা শেষ হতে পেলো না,কারন সকলেই হাঁ হাঁ করে উঠেছে। এই মাগগিগন্ডার বাজারে একটা বিড়িও বহুমূল্য। শান্তনু এ রসে বঞ্চিত, তাই এত সহজে কথাটা বলতে পেরেছে,নয়তো প্রাণে ধরে এমনটা ও করতে পারতো কি?
আমরা পরস্পর এই সমস্ত বিষাক্ত আলোচনা করছি,এমন সময় মেঘ না চাইতেই জল।
তাড়াহুড়োতে বেরিয়ে যাওয়ার কারনে ছেলেদুটো খেয়াল করেনি বাইরের টেম্পারেচার কতটা নির্মম হতে পারে। সকাল সাড়ে সাতটাতেও বাঘা শীত জাপ্টে রেখেছে শান্তিনিকেতনের সর্বাঙ্গ। এর মধ্যে সন্দীপ আবার একটু সুখী প্রাণী। ঠান্ডা গরম একটু এদিক সেদিক হলেই কাতর হয় পড়ে। কলকাতা থেকে সে একটা বাহারী কানঢাকা টুপি নিয়ে এসেছে,আর সূর্য ডুবলেই সেটা পরে ফেলছে। এই তুরীয় মুহুর্তে আমাদের টুপি ফুপির কোন খেয়ালই থাকতো না,কিন্ত সে আবার খুব হিসেবী মানুষ, সব টিপটপ হওয়া চাই।
অতএব,
- ওইইই। আমার টুপিটা একবার দে তো।
নীচ থেকে আমাদের উদ্দেশ্য করে তার হুকুম ভেসে এলো।
সকাল সকাল পেটে কিছু পড়েনি। এইসব কান্ডের মধ্যে চা জুড়িয়ে জল। তারপর ওই মেয়ে দুটোর কাছে আমাদের চরিত্র ফুল গ্যামাক্সিন। এর পরে টুপি!!! বারুদে যেন বিড়ি পড়লো একটা।
মৈনাক একটা ক্রূর হাসি দিলো। তারপর জানলার কাছে গিয়ে মধুক্ষরা কন্ঠে বলে উঠলো - কার টুপি রে? তোর,না তোর ভাইয়ের?
প্রথমে পাঁচ সেকেন্ডের নীরবতা। সন্দীপ চুপ। অনির্বান চুপ। মেয়েগুলো মাথা নীচু করে চুপ। একটা কাঠবেরালি সামনের সজনেগাছে ডাকাডাকি করছিলো। সেটা পর্যন্ত স্পিক্টি নট।
তারপরে হা হা হি হি খুঁ খুঁ খৌয়া খৌয়া!!
শান্তনু হাসতে হাসতে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলো।
এরপরে সন্দীপ আর অনির্বাণের বুক ভরা আশা যে ধুক করে নিভে গিয়েছিলো, সেটা আশা করি বলে দিতে হবেনা। কিছুক্ষন পরে ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ওরা আমাদের কি বলতে পারে তার জন্যও কোন প্রাইজ নেই। তবে মেয়েগুলোকে আর ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। আমার ধারনা, সেদিনই ওরা শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে।
আমাদের নিয়ে ভ্যাজরং অনেক হোল।আপাতত খানিকক্ষণ যতি। তবে সেই শুনে আপনি যে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শোবেন - সেটি কিছুতেই হতে দেবোনা।আমরা আবার ফিরে আসবো স্বমহিমায়। তবে তার আগে " সেই আমলে শান্তিনিকেতন " কেমন ছিলো, সেটা একটু বলা দরকার।
সেই আমল? সেই আমল মানে? রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আপনারা কি co founder?
হেঁ হেঁ। চটছেন কেন। না মানে,এই বছর পনেরো আগের কথা।
বছর পনেরোওওওও!!! তখন ওখানে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো বুঝি?
এই দেখুন,আপনি আবার চটে যাচ্ছেন। হ্যাঁ মশাই, মাত্র পনেরো বছর আগের কথা। তবে এরই মধ্যে শান্তিনিকেতনের নানারকম ছোট বড় এদিক ওদিক যা হয়েছে, সেটা ব্যক্ত করতে বড্ড ছটফটানি লাগছে হঠাত। তাহলে শুরু করি? না না, এই দু চারটে ফারাকের পাঁচালী। বেশি সময় নেবোনা।
সেকাল এবং একালের মধ্যে প্রথম, এবং প্রধান যে ফারাকটা চোখে পড়ে,সেটা হোলো হুজুগে পাবলিকের ভীড়। এটা তখনও ছিলো। কিন্ত এত বীভৎস ছিলোনা। এই পিরীতের সাথে একমাত্র পাল্লা দিতে পারে সিগনালে রবীন্দ্রসংগীত বাদনের অত্যাচার। বিশেষ করে দোলের সময়ে যে লেভেলের ভীড় হয়, তাতে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা যখন তখন হয় যেতে পারে। গরদের পাঞ্জাবী ফৌজ আর পৃথুলা আদি ঢাকেশ্বরী বাহিনী মহামারীর মতো পালে পালে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে দোলে, পৌষমেলায়,বা খ্রীষ্টোতসবে ওখানকার মানুষের আনাগোনা গেছে কমে। আমি নিজের চোখে দেখেছি স্থানীয় মৌলবীসাহেব কাঁচের মন্দিরের চাতালে বসে বুঁদ হয় শুনছেন ব্রহ্মোপাসনা। মেলার মাঠে ফকিরি গানের আসরে দেহতত্ত্ব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে একজন সাঁওতাল রমনী। সেইসব দৃশ্য আর দেখা যায়না।
দ্বিতীয় ফারাক দেখা গেছে নিরাপত্তায়।
নোবেল চুরি হওয়ার পর থেকে আশ্রম কতৃপক্ষ " চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে " আপ্তবাক্য বুকের মধ্যে নিয়ে চত্বরটাকে প্রায় জেলখানায় রুপান্তরিত করেছেন। পর্যটকদের মোটামুটি ছাগল চরানোর মতো " এইখানে দাঁড়াবেন না", "ওইখানে বসবেন না", এই দিকে এক ঠ্যাঙে লাফিয়ে চলুন, ওইদিকে মাথা নীচে পা ওপরে করে থাকুন ", বলে জিনা হারাম করে দেবে। ভীড়ভাট্টার সময়ে এদের মুখচোখ দেখে মনে হয় পারলে জনতার ওপরে টিয়ার গ্যাস চার্জ করে। আপনি রিক্সা থেকে নামতে বাধ্য হবেন প্রায় মাইল খানেক দূরে। তারপর খাবি খেতে খেতে হন্টন। সঙ্গে বয়স্ক মানুষ থাকলে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য এখন হয় দাঁড়িয়েছে যে কোন প্রকারে চত্বরের মধ্যে আপনাকে ঢুকতে না দেওয়া। মানে না রহেগা বাঁশ,না বজেগি বাঁশুরি। সেটাই তো সবচেয়ে সহজ। আর আমাদের আমলে? সাতই পৌষ সকালবেলায়, বৈতালিক শেষ হয় যাওয়ার পরে উত্তরায়ন চত্বরে ঢোকার কোন বিধি বাঁধন থাকেনা। উদয়ন, অথবা কোনার্কে আজকাল প্রবেশ নিষেধ। অথচ আমি দিব্যি গায়ে হাওয়া দিয়ে উদয়নের এ ঘর করে বেড়িয়েছি সেদিন। এখন তা শিবের অসাধ্যি। যে অচলাতয়ন ভেঙে ফেলার ডাক দিয়েছিলেন বিশ্বকবি - সেই অযথা নিয়মের নিগড়েই তার প্রিয় শান্তিনিকেতন আজ বাঁধা পড়ে গেছে।
তৃতীয় ফারাক দেখা গেছে উন্নয়নের। প্রথমবার যে প্রান্তিক স্টেশন আমি দেখেছিলাম, সেটা ছিলো লালমাটির একটা বাঁধানো চত্বর মাত্র। এখন আপনি গেলে হাঁ হয় যাবেন। ইয়া ওয়েটিং রুম,ঝাঁ চকচকে প্ল্যাটফরম - কি নেই সেখানে। স্টেশনের পেছনে যে জংলা ডাঙা ছিলো সেখানে মাথা তুলেছে সারি সারি বিষন্ন রেল কোয়ার্টার। প্রান্তিক আজ আধুনিকা। শুধু আমার ছোটবেলার খুদে স্টেশনটা হারিয়ে গেছে। এছাড়াও এদিকে ওদিকে একশো রিসর্ট, দুশো বাড়ি উঠে এখানকার উদার আকাশকে কেমন যেন ভাগাভাগি করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। যে উদার প্রকৃতির জন্যে আমি বারবার ছুটে গেছি,সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয় যাচ্ছে চোখের সামনে। শুনেছি সোনাঝুরির লাল মাটির রাস্তাটাকেও নাকি পিচে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ওই কাঁচা পথের উপরে লাল কাদা কিম্বা ধুলো মেখে অনেক বর্ষা বসন্ত কাটিয়েছি। উন্নয়নের চাপে সেইসব এখন স্মৃতি।
উন্নয়নের দাঁত নখ কিভাবে সারল্য আর সুন্দরকে ধ্বংস করে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় শনিবারের হাট। প্রথম যখন এই হাট বসতে থাকে, আমি সেই সময় থেকেই এর বিবর্তনের সাক্ষী। শুরুর দিকে হাট বসতো প্রকৃতি বীক্ষন কেন্দ্রের ভেতর। এই কেন্দ্রটি বস্তুত কলাভবনের ছেলেপুলেদের করা কিছু বিমূর্ত ভাস্কর্যে ঘেরা। সেখানেই শনিবার দিন জড়ো হতো নানান কিসিমের লোকজন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কাছের গ্রাম থেকে দুজন বউ নিয়ে এসেছে বেগুন, ঝিঙ্গে,লাউ। তার পাশেই এক ফ্রেঞ্চ রমনী বসে গেছেন দুর্দান্ত জিঞ্জার ব্রেড নিয়ে। তার পাশেই হয়তো আবার কলাভবনের কোন থার্ড ইয়ার ছোট ছোট পোস্টকার্ড এঁকে নিয়ে এসে হাজির। বোধকরি গুরুপল্লীর দুই গুরুপত্নী নিয়ে এসেছেন বাড়িতে তৈরি পিঠে। এক বুড়ি কয়েকটা নক্সীকাঁথা আর রঙচঙে পুঁতির মালা নিয়ে বসে গেছে। খরিদ্দার প্রায় সবাই স্থানীয় আর কয়েকজন টুরিস্ট। আড়ালে কয়েক কলসী হাঁড়িয়াও দেখা যাচ্ছে। আপনাকে আশ্রমে যেতে হবেনা। রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবেনা।বিশ্বভারতীর মূল সুর বোঝার জন্য এই হাটে আসাই যথেষ্ট। এ হচ্ছে সেই আমলের কথা। আর এখন? বিশাল বিশাল গাড়ি চেপে বাবু বিবিরা আসেন। তাদের সাথে আসে পেটমোটা বাচ্চার দল। তারা সব রোদচশমা আর বার্মুডা পরে হুমহাম করতে করতে দরাদরি করে। হাটও সরে গেছে অনেক পেছনের দিকে। সেখানে এখন হ্যান্ডিক্রাফটের পশরা যেগুলো প্রায় সবই আপনি পাবেন অন্য জায়গাতে। পার্থক্য খালি এখানে খোলা আকাশের নীচে চলছে কারবার, তাই বেশ একটা ফোকি ফোকি ভাব। পারফর্মিং বাউলরা চলে আসেন সাইকেল নিয়ে। দু একটা চেনা গান করেন। প্যালা পড়ে। বাবুরা ভাবেন, বা: শান্তিনিকেতনের কি এথনিক আবহাওয়া!! এই গোলমালের মধ্যে সেই খ্যাপা বৈরাগী শুধু অদৃশ্য হয়েছে, যার কাছে আমি অসাধারন কিছু গান শুনেছিলাম। হ্যাঁ, ঠিক এই শিমুল গাছের তলায়।
বইমেলায় টিকিট তুলে দিয়ে যে গরুর হাট তৈরি হয়েছে, শান্তিনিকেতনের আজ সেই অবস্থা। তার জলবায়ুর মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন খ্যাপামি ছিলো,তার জায়গা করে নিয়েছে শহুরে বেহুদা কোলাহল। আমরা যে শান্তিনিকেতনে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছি,তার মধ্যে তখনও কিছুটা বেখেয়ালীপনা ছিলো। তাই হয়তো খুচরো খাচরা পাগলামী গুলো করতে পেরেছিলাম। তার কিছু ক্ষনস্থায়ী,কিছু আবার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখনো জীবন্ত।
এই পর্বটি লেখা শেষ করে আপাতত আমার বকবকমে ইতি টানবো। বন্ধুবান্ধবের কীর্তিকলাপ লিখতে বসলে খাতা বন্ধ করা সত্যিই মুশকিল। কিন্ত সময়াভাবে নিয়মিত বসাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয় দাঁড়াচ্ছে। একটা দায়ভার চেপে বসছে সেই কারনে। আপাতত সেই দায় কাঁধে নিতে আর ইচ্ছে করছেনা। যেদিন ফের মাথায় পোকা নড়েচড়ে বসবে - পেন কামড়ে আবার শুরু করা যাবেখন।
শান্তিনিকেতনে আমাদের নষ্টামির শেষভাগ নানা রঙে রঙীন। তার একদিকে যদি ভৌতিক গা ছমছম, তো অন্যদিকে রোমান্সের গোলাপী প্রজাপতি। কখনো ফুটে বেরোচ্ছে স্বেচ্ছাচারের কালোহাত, আবার অন্যদিকে সাম্যবাদী হাউমাউ। কোনটার দিকে বেশী ফোকাস মারবো সেটাই হলো আসল হার্ডল।
বরং আমাদের " দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান " কাণ্ডকারখানা গুলোই আগে বলা যাক।
হয়তো মনে আছে যে শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই আমার বন্ধুরা ভারতীয় রেলের তহবিলে একশো পঁচিশ টাকা জমা করেছিলেন। স্বেচ্ছায় নয় অবশ্য, করেছিলেন ফাইন হিসেবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হয়েছিলো বলা যায়না,তবে বন্ধুরা প্রায় সর্বহারার পর্যায়ে নেমে এসেছিলেন। এই দুর্ঘটনার কারনে নানাভাবে বাজেট কাটছাঁট করার প্রয়োজন হয় পড়ে,নয়তো সেই শীতকালটা বোলপুরেই থেকে গিয়ে একশো দিনের কাজ টাজে নাম লেখানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকতোনা। বাজেট ছাঁটাইয়ের ফলে প্রথম কোপ পড়ে নেশার দ্রব্যে,অর্থাৎ সিগারেটের হাইওয়ে ছেড়ে বিড়ির কাঁচা রাস্তা ধরতে হয়। দ্বিতীয় কোপ পড়ে পরিবহনে। শান্তিনিকেতনের রাঙা ধুলোয় আমাদের পা বারবার লাঞ্ছিত হতে থাকে,কিন্ত আমরা সাচ্চা সংযম দেখিয়ে রিক্সা বা ভ্যান রিক্সার আকুল আহবান থেকে নিজেদের বিরত রাখি। সেই পাঁচদিনে যে দূরত্ব আমরা চষেছিলাম, তাতে সম্মিলিত ভাবে হয়তো পায়ে হেঁটে কলকাতাই পৌঁছে যাওয়া যেতো। এই ম্যারাথনের ফলে আমাদের অবশ্য খুব একটা হেলদোল দেখা যেতোনা,কারন সামনে যদি লক্ষ্যবস্তু থাকে কোন অষ্টাদশী তো আমরা জাহান্নমেও পাড়ি জমাতে পারতাম তখন। আজ্ঞে হ্যাঁ,একথা অস্বীকার করে আর লাভ নেই,যে মহান কবির কীর্তিস্থলে আমরা কিছু উচ্চ চিন্তা নিয়ে যাইনি,গেছিলাম মূলত মেয়েবাজী করতে। সেটা করতে করতেই কখন যে বিকেল ঢলে সন্ধে হয় রাত্তির গড়াতো, খেয়ালই থাকতোনা। বিকেল চারটে সাড়ে চারটের মধ্যে যথোচিত মাঞ্জা মেরে বেরিয়ে পরা হতো। আমাদের বাড়ি থেকে মেলার মাঠ পায়ে দম থাকলে আধা ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। জনা সাতেক উঠতি জোয়ান পাশাপাশি কলার উঁচিয়ে হাটতাম। তখন " কাঁটে " সিনেমাটা সদ্য রিলিজ করেছে। সেই খলনায়ক গোষ্ঠীর মতো ভাও খেতে খেতে কি যাওয়া আমাদের, সে যদি তোমরা দেখতে!!! এইভাবে মেলা চত্বরে ঢুকে হ্যান্ডিক্রাফটের স্টল থেকে শুরু করে সিউড়ির আচার পেরিয়ে " হরেক চিজ পাঁচ টাকা"র দিকে কান না দিয়ে আমরা বাউল ফকিরের আখড়ায় গিয়ে বসতাম।
স্টেজে তখন একটা লোক তার সপ্তক ছাড়িয়ে ভাবে বিভোর। তার সাথে সঙ্গত করছে যে বাঁশুরিয়া, সেও আগুন ছোটাচ্ছে। হবে নাইবা কেন? মঞ্চের পেছনে তখন নীল নীল ধোঁয়ায় তাজ্জিম মাজ্জিম অবস্থা।এই সমস্ত কান্ড করে যখন পেটের ভিতরে চোঁ চোঁ করতো,আর মেয়েদের ঠ্যাঙের দিকে তাকিয়ে চিকেন তন্দুরীর লেগ পিস মনে পড়তো, আমরা রণে ভঙ্গ দিতাম। খাওয়া দাওয়াতেও একশো পঁচিশ টাকা তার কালো হাত বাড়িয়ে দিতো। আমরা কঠিন মুখ করে রুটি আর ঝালঝাল ডিমের তরকারী খেতে বসতাম এক প্রায়ান্ধকার ঝুপড়িতে। ওই চত্বরে সেটাই সবচেয়ে সস্তা ঠেক। আমাদের পাশে বসে ঝিমোতো ডেইলি বাংলু খাওয়া একটা মাল। পায়ের নীচে একটা লুব্ধ ছাগল ঘুরঘুর করতো। দূরে মেলার হট্টগোল আর আলো ঝুলে থাকতো জমাটি ঠান্ডায়। দুপুরের খাওয়া আরো শস্তায় করা যেতো বিশ্বভারতী ক্যান্টিনে। সেখানে দশ টাকায় রুটি এবং তড়কা পাওয়া যেতো। ক্ষিদের মুখে সবই উড়ে যেতো বটে, তবে এ কথাটা অস্বীকার করে উপায় নেই যে তড়কায় নুনের মাত্রাটা কিঞ্চিৎ বেশি হত আর কি। সত্যি বলতে কি আমাদের চাপাচাপিতে বান্টিসোনা কিচেনে প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিলো এটা জিজ্ঞেস করতে, যে রান্নার ঠাকুর কি তড়কাতে নুন দিয়েছে না নুনে তড়কা দিয়েছে। ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত আর অতোদুর গড়ায়নি,নইলে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ হয়তো অতটা শান্ত আর থাকতোনা। বাড়ি ফিরে দুটি জিনিস করা হতো। এক বালতি জল গরম করে তার মধ্যে পালা করে পা ডোবানো হতো। সেকি অনির্বচনীয় সুখ, আহা আহা!! কোথায় লাগে পাঁচতারা হোটেলের স্পা। সারা সন্ধে হেঁটে এসে সেই আদরের ছোঁয়া নিয়ে আমরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতাম। তারপরে অনির্বাণ মুখে একটা ভিলেনি হাসি টেনে বলতো : বেশ। এবার শুরু করা যাক।
আমরা ফরাসের উপরে গম্ভীর ভাবে বসতাম। একে অপরের মুখোমুখি। যাকে বলে রহস্যের খাসমহল।
সৌম্য ( মৈনাকের দিকে তাকিয়ে) :
- বের কর।
মৈনাক তার জ্যাকেট থেকে একটা কিছু বের করে মাঝখানে রেখে হিসহিসে গলায় :
- এবার তোর পালা।
সৌম্য তার টুপির ভেতর থেকে বের করলো বের করে আনলো আরো মারাত্মক জিনিস। মৈনাকের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
আমি সন্দীপকে বললাম :
- ভালোয় ভালোয় এবার সামনে রাখ যা এনেছিস।
সন্দীপ আমার থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে প্যান্টের গোপন পকেট থেকে যা বের করে আনলো তাতে ঘরের মধ্যে খেলে গেলো হাল্কা শিহরন।
বান্টি মাথা নীচু করে বসে আছে। সে কিছুই আনেনি। তার ভাগ্যে ঝুলছে হয় কুমীর দিয়ে খাওয়ানো,নয় পাহাড় থেকে ধাক্কা। তাকে অবশ্য বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
এবারে অনির্বাণ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একেবারে পেশাদারী দক্ষতায় যা আমাদের সামনে রাখলো, তাতে শান্তনু আর থাকতে না পেরে হাততালি দিয়ে উঠলো : উফহহহহ গুরু গুরু!!!
আমরা সবাই তাকালাম সামনের দিকে। সেখানে আস্তে আস্তে ডাঁই হয় উঠছে কাঠের সিগারেট কেস ( সন্দীপ) নীল রঙের বেড়াল আঁকা চামড়ার বটুয়া ( মৈনাক) ফেঙ শুইয়ের ক্রিস্টাল গ্লোব ( আমি), একটা চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ ( সৌম্য), পাঁপড়ের প্যাকেট ( শান্তনু) আর ইয়াব্বড় একটা টেডি বিয়ার ( অনির্বাণ)।
না:। এর কোনটাই গাঁটের কড়ি ফেলে কেনা নয়। প্রত্যেকটি বস্তু ঝাঁপা। সাহেবী ভাষায় একেই বলে shop lifting। মেলাতে ঘোরার এই আমাদের আরেকটি কারন।
কেন করতাম এরকম? অভাবে স্বভাব নষ্ট? Anti establishment আন্দোলন? গণ ক্লেপ্টোম্যানিয়া? Adventure? এখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করলে এর ঠিকঠাক উত্তর পাইনা। হয়তো এর কোন একটা কারন নেই, প্রত্যেকটাই একটু একটু করে মিশে আছে একে অন্যের সাথে। আমি যে কারনে ক্রিস্টাল গ্লোবটা ঝেঁপেছিলাম,তার কারন ভারী অদ্ভুত। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় বাস্তু এবং ফেং সুই হঠাত পূব দিগন্তে উদিত হয় হুড়মুড় করে ঘাড়ে এসে পড়ে। ঈশান কোনে কাচের ব্যাঙ রাখবেন, না কমোডের উপর জেড পাথরের খরগোস সেই নিয়ে টিভিতে চুলচেরা বিচার করা হতো। আমার এই সব বুজরুকি অসহ্য লাগতো মানে জাস্ট নিতে পারতাম না।ধারনের আঙটি, বেড়াল কাটা, বিপত্তারন মাদুলি, মন্দিরে মানত ফানত শুনলে চিরকাল আমি সেই স্থান এবং সেই লোকের সাহচর্য এড়িয়ে এসেছি। ফেং সুইয়ের উপর আমার আক্রমণ হলো সেই কারনে। আমাদের মধ্যে অন্য কেউ আবার হয়তো নিতো বান্ধবীকে ঝাক্কাস উপহার দেবে বলে। নিছক মজা করার জন্যও যে করা হতোনা, তা বলা যাবেনা। আবার কেউ অতিরিক্ত দামে জিনিস বিক্রি করলে তাকে সহবত শেখানো হতো এইভাবে। এই ঝাঁপা পর্বের, বলাই বাহুল্য,শুরু বা শেষ কোনটাই পৌষমেলায় নয়। তবে হ্যাঁ,একটা জিনিস মাথায় রাখা হতো। এমন কোন জায়গা থেকে ঝাঁপা হতোনা যেখানে দোকানদার নিতান্তই গরীব। অর্থাৎ মেলাতে মাটির উপর বসে যেসব শিল্পী ডোকরার জিনিস বিক্রি করতো,তারা হাঁড়িয়ার নেশায় টঙ হয়ে থাকলেও আমরা সেখানে যেতাম না। শুধু মাত্র বড় দোকানগুলিকেই টার্গেট করা হতো,যাদের পসরার সমুদ্র থেকে দু আঁজলা নিলে খুব একটা কিছু যায় আসবেনা আর কি। অত:পর যার যেমন দরকার সে অদলবদল করে নিতো,নয়তো নিজের জন্যই হয়তো রেখে দিলো। যেমন সৌম্য নিলো সন্দীপের সিগারেট কেস,ওর বাবাকে দেবে। সন্দীপ পেলো চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ তার মায়ের জন্য। ওদিকে অনির্বাণ নিজের কাছেই টেডি বিয়ারটা রাখলো,নাকি প্রেমিকাকে দেবে। ( অমন ধামড়া মাল ব্যাটা হাতসাফাই করলো কি করে সে এক রহস্য!!)। শান্তনু জাতির উদ্দেশ্যে ( মানে আমাদের উদ্দেশ্যে) পাঁপড়ের প্যাকেট দান করলো, আর বদলে পেলো আমার ক্রিস্টাল গ্লোব,কারন ওটা নিয়ে আমি কিই বা করুম? এই হচ্ছে কেস।
এটুকু বলার পর আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যারা এই লেখাটি পড়ছে তাদের চোখে আমরা একাধারে চার্লস শোভরাজ থেকে শুরু করে দাউদ ইব্রাহিম হয়ে হয়তো বা বিজয় মাল্যের মতো কৃতকর্মা হয় উঠেছি। হয়তো তারা আমাদের সাথে সম্পর্কই রাখবেন না। তাদের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে বোধহয় বাটি চামচ গুনে টুনে রাখবেন।পুলিশে হুলিয়া বেরোলেই বা আটকাচ্ছে কে? তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি মোটামুটি কলেজে থাকতে থাকতেই এই কর্মকান্ডে আমরা ইতি টানি। এসব আর তখন মজা দিচ্ছিলো না। মন তখন খুঁজে পাচ্ছিলো অন্যতর উষ্ণতা।
শান্তিনিকেতন বাসের এক পর্যায়ে এসে হঠাত আমরা ঠিক করলাম যে প্ল্যানচেট করবো। এই আইডিয়াটা আসার পেছনে অবশ্য একটা কারন আছে। বা বলা যেতে পারে পটভূমিকা।
পৌষমেলা থেকে ফিরতি পথে, আমাদের কমপ্লেক্স আর শ্যামবাটির মোড়ের মধ্যে ছিলো একটা নির্জন গোছের পথ। শ্যামবাটির মোড় হচ্ছে সেই চৌরাস্তা যার একদিকে হাঁটলে আপনি পৌঁছবেন আশ্রমে, আরেকদিকে গেলে পড়বেন খোয়াইতে। সামনে সোজা গেলে গোয়ালপাড়া হয়ে রাস্তা মিশবে সিউড়ি যাওয়ার পাকা সড়কে আর চার নং রাস্তাটি শেষ হবে প্রান্তিক স্টেশনে। প্রান্তিক স্টেশনের একটু আগেই সোনার তরী কমপ্লেক্স। এই রাস্তাটাই রাত্তিরে হয় পড়তো নি:ঝুম। রাস্তার ডান হাতে সমান্তরালে বয়ে চলা ময়ুরাক্ষী খালের থেকে উঠে আসতো কুয়াশা। ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্টের সাথে জোনাকীদের ব্যালে দেখা যেতো। অপর পাড়ের ঝুপসি জঙ্গল ভেদ করে সীমান্তপল্লীর কুঁড়েঘরের দু একটা টিমটিমে আলো ছাড়া ছিল অখন্ড অন্ধকার।শুক্লপক্ষ হলে আকাশ দিয়ে শনশন করে উড়ে যেতো পরিযায়ী পাখি। কৃষ্ণপক্ষে শোনা যেতো প্যাঁচার ডাক। এর সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা মিলিয়ে পরিস্থিতি দস্তুরমতো রোমাঞ্চকর করে তুলতো। এমনই এক রাতে মেলার মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে আলোচনা হচ্ছিলো সামনের এই রাস্তাটা কোন নওজোয়ান একা হেঁটে পার হতে পারবে? দেখা গেলো কেউই এ ব্যাপারে পিছপা নয়। সকলেই আফ্রিকায় গিয়ে একা হাতে সিংহ শিকার কিম্বা বিন লাদেনকে লুডোয় হারিয়ে দেওয়ার মতো দুর্জয় ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে। তবে ইয়ে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় সাপখোপ, পোকামাকড়, ডাকাত গাঁটকাটা রয়েছে তাই...। আমরা সবাই যখন একে অন্যকে এই কথা বলে বেশ একটা সর্বদল সমন্বয় করছি হঠাত কথা নেই বার্তা নেই সন্দীপ খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বললো : আরে ছাড় ছাড়। সব একেকটা ভীতুর ডিম! কারো ইয়েতে ইয়ে নেই আবার বড় বড় বাতেলা? কি???? এও শুনতে হলো ? এ তো রজনীকান্তকে " Action জানেন" জিজ্ঞেস করা!!! শারুক্ষানকে রোমান্সের বিষয়ে লেকচার দেওয়া!!! অনু মালিককে অরিজিনাল সুর করতে পরামর্শ দেওয়া!!! না:। এই অপরাধের ক্ষমা নেই। সন্দীপ বাদে আমরা সবাই দাঁত কিড়মিড় করে ঠিক করলাম এর একটা বিহিত করতে হবে।
আগেই বলেছি যে রাস্তার ওপর দিয়ে সোনার তরী যাওয়া যায় সেটা বেশ নি:ঝুম। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট আছে বটে কিন্ত বালব নিখোঁজ। এটা দেখে আপনি জটায়ুর মতো " dacoits" বলে দু:খপ্রকাশ করতে পারেন কিন্ত কিছু করার নেই। তবে হাতে টর্চ থাকলে কোন চাপ নেই,আর সামনে সোনার তরীর আলো, ডানদিকে মেলার মাঠে আলোর আভা, সব নিয়ে মোটামুটি নজর চলে। তবে শীতকালে সরু নির্জন রাস্তা তো সরু নির্জন রাস্তাই। সুতরাং আমরা মোটামুটি একসাথেই হাঁটতাম। সন্দীপের ন্যক্কারজনক কথার পরে ঠিক হল, যে ওকে কৌশলে দলছাড়া করতে হবে। দেখা যাক ব্যাটা একা এই রাস্তা দিয়ে কিভাবে যায়। সেই মতো আমরা ওকে নানাভাবে তাতাতে শুরু করলাম। মানে " তুই পারবি একা হাঁটতে " থেকে শুরু করে " নিজে শালা অন্ধকারে মায়ের হাত ধরে চলিস " জাতীয় অপমান। এইভাবে সন্দীপের পৌরুষে ক্রমাগত ঘা দিতে দিতে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হলো। কয়েকটা কাঁচা খিস্তি র অলংকারে আমাদের ধন্য করে সে গটগট করে একাই হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। আমরাও ততোধিক আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। এইভাবে পাটিগণিতের নিয়মে আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। একটু পরেই সন্দীপের বাদামী জ্যাকেট আর দেখা গেলোনা আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর ভেসে এলো : তোরা কোথায়ায়ায়ায়।
যীশুখ্রীষ্ট বা বুদ্ধদেব দয়ার অবতার হলে কি হবে,তাদেরও কিশোরবেলা ছিলো। কেউ তো আর খোকা বয়েস থেকে দুম করে দামড়া হতে পারেনা। আর আমি হলপ করে বলতে পারি সেই লেভেলের কেউ আজ আমাদের মধ্যে থাকলেও এই ডাকে সাড়া দিতেন না। কারন দেশে দেশে যুগে যুগে আঠারো বছরের ছেলেপুলেদের কেউ এই চরম খিল্লির সুযোগ ছাড়ে না। যারা ছাড়ে তাদের ডাক্তার দেখানো উচিৎ। সুতরাং আমরা চুপ করে থাকলাম। সন্দীপ আবার ডাকলো। এবারে " ওরেএএএ" বলে হাহাকার। আমরা তবুও চুপ। তৃতীয়বার চরাচর ভেদ করে সন্দীপের যেই : শালা শুয়োরের..." শুরু হয়েছে,ঝপাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। সোনার তরী ব্ল্যাক আউট,মেলার মাঠের আলো ব্ল্যাক আউট, পেছনে শ্যামবাটির মোড়ে শ্যাম বাটি বা মোড় - কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। সেই ঘনান্ধকার পরিবেশ আরো জমাটি করে "ক্র্যাও, ক্র্যাও" আওয়াজে মাথার ওপর দিয়ে একটা রাতচরা পাখি উড়ে গেলো। আমরা একটু ঘাবড়ে গেলেও একসাথে আছি বলে মোটামুটি সামলে নিলাম। কিন্ত সন্দীপ? তার কি হলো? কোন সাড়াশব্দ নেই কেন? আমরা মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে পড়িমরি করে দৌড়লাম। কিন্ত সে কোথায়? রাস্তার উপরে তো নেই। খালের দিকে নেমে গেলো নাকি অন্ধকারে? হয়তো রাস্তার বাঁক বুঝতে না পেরে সোজা এগিয়ে গেছে সামনের বনবাদাড়ের দিকে। কিন্ত আমাদের সমস্বর হাঁকডাক শুনেও তার কোন পাত্তা নেই কেন? হঠাত রাস্তার বাঁদিকে নজর গেলো। সেখানে কিছু জঙ্গুলে গাছ আর আগাছা মিলে বেশ একটা ঘেরাটোপ তৈরি করেছে। তার ভেতর থেকে কেমন খচমচ আওয়াজ ভেসে আসছে না? ওরে বাবা!! কেয়ারটেকারের কাছে শুনেছিলাম ধারেকাছে নাকি একটা খ্যাপা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে কি...। ঝোপের পেছন থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। আমরা যে যা পারলাম ইঁট বা গাছের ডাল বাগিয়ে ধরলাম। সেই কড়া ঠান্ডার মধ্যেও কপালে বিনবিনে ঘাম দেখা দিলো।ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সোনার তরীর পেছন থেকে উঁকি মারলো শুক্লপক্ষের ফুটফুটে চাঁদ। আর আমরা দেখলাম... ও হরি!!! এ যে হতভাগা সন্দীপ। মুখ চোখের অবস্থা শোচনীয়। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। কেস কি?
আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য তার মধ্যে বিশেষ কোন হেলদোল দেখা গেলনা। সবার দিকে একবার কটমট করে আবার সামনের দিকে হাঁটা দিলো সে।
সোনার তরীতে পৌঁছলাম। চারিদিকে অখন্ড লোডশেডিং। খাওয়াদাওয়ার পাট আগেই চুকিয়ে দিয়েছিলাম,তাই আলোর বিশেষ প্রয়োজন ছিলোনা। জামাকাপড় খুলে হিসু করে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লেই হয়। কিন্ত আমাদের মাথায় তখন খেলছে অন্যকিছু। শীতের রাত।লোডশেডিং। চারিদিক চুপচাপ। এ কিসের আদর্শ পরিবেশ? বরাবরের মতো এবারও অনির্বাণ প্রকাশ করলো সবার মনোবাসনা।
- চল। প্ল্যানচেট করা যাক।
বাস্তবিক মনেই হচ্ছিলো যে আজকের নির্জনতা কেমন অপার্থিব গোছের। লোডশেডিং হওয়া এমন কিছু নতুন ব্যপার তো নয়। কিন্ত আজ যেন সবকিছু বড্ড বেশি থম মেরে আছে। যেন কেউ বা কারা চাইছে একটা যোগাযোগ হোক। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। তারপর আমি প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো ড্রয়ার থেকে বের করে আনলাম একটা মোমবাতি।ঘরের মাঝামাঝি একটা মোড়া টেনে নিয়ে এসে তার ওপরে সেটাকে স্থাপন করা হলো। সবাই বসলাম গোল হয়ে। সৌম্য দেশলাই জ্বালিয়ে প্রজ্জ্বলিত করলো মোমের শিখা। অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছটা অতিকায় ছায়া থরথরিয়ে কেঁপে বেড়াতে লাগল। সাত নাম্বার ছায়াটির মালিক অবশ্য ঘরে ঢুকেই জুতো মোজা খুলে কম্বলের তলায় সেঁধিয়েছে। দু একবার "ওরে সন্দীপ" ডেকেও তাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া গেলোনা। বাধ্য হয়ে আমাদেরই শুরু করতে হলো ওই পারের সাথে এক অলৌকিক যোগাযোগ।
প্রথম সমস্যা হলো কিভাবে প্ল্যানচেট শুরু করা যায়। মিডিয়াম থাকলে অবশ্য কাজটা সহজ হতে পারে,কিন্ত একজন মিডিয়াম হতে গেলে যে মানসিক গঠন দরকার ( মানে যেটুকু পড়েছি আর কি) সেটা আমাদের কারুর মধ্যে নেই। আরো একটা উপায় আছে। কোন কাপ অথবা বাটি জোগাড় করে সেটা একটা টেবিলের ওপর রেখে তারপর আহবান করা। টেবিলের উপরে হ্যা অথবা না লিখে মোটামুটি কথোপকথন চালানো যেতে পারে। অবশ্য চক দিয়ে A থেকে Z অব্দিও লেখা যায় এবং আলাপচারিতা বেশ ভালোভাবেই হয়,কিন্ত তাতে প্রচুর সময়ের অপচয় হবে। আমাদের কেমন যেন মনে হচ্ছিলো যে যা করার এক্ষুনি করতে হবে,নইলে সংযোগ করতে পারা যাবেনা আর। ঘরে টেবিলের অভাব। তাই বাসন রাখার একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে এসে তার ওপরেই একটা কাপ রাখা হলো। এইসব যোগাড়যন্ত্র করে একে অন্যের আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁইয়ে প্রস্তুতি শেষ হল।
এইবারে দ্বিতীয় সমস্যা। কাকে ডাকা হবে? কাছাকাছি প্রিয়জন কেউ?নাকি বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব? কোথাও একটা পড়েছিলাম যে অপঘাতে মৃত হলে আত্মা সহজে ধরা যায়। কিমাশ্চর্যম!!! আমি ঠিক এই কথাটা ভাবার সাথে সাথে যেন আমার চিন্তার সুতো ধরেই মৈনাক ফিসফিসিয়ে বললো : সোহমকে ডাকলে কেমন হয়?
সোহম। সোহম হালদার।আমাদের স্কুলের বন্ধু। বছর খানেক আগে দেশের বাড়ি কালনায় গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে মারা গেছে। আমাদের সবার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে তার মুখ। বন্ধুদের ডাকে সে কি না এসে পারবে?
- ওক্কে। সোহমকেই ডাকছি আমরা।
শান্তনু ঠান্ডা গলায় বললো।
অত:পর সেই মৃত্যুশীতল রাতে একটি মাত্র মোমবাতির আলোর সামনে ছটি সম্মোহিত অস্তিত্ব সোহম হালদারকে ডাকতে লাগলো,যে অনেক দুরের পথে পাড়ি জমিয়েছে। আমরা চোখ বন্ধ করে সোহমের মুখটা মনে করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। একটা গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। কেয়ারটেকার ঢোকার সময়েই বলছিলো কোথাও একটা ট্রান্সফরমার ফেটেছে তাই আলো আসতে অনেক রাত হবে। সেটা কি সত্যি? নাকি এর পেছনে অন্য কোন সংযোগ আছে। কেয়ারটেকারের মুখটা অন্ধকারে ঠিক খেয়াল করিনি। ওর গলাটা কি রকম অন্যধাঁচের লেগেছিল না? তার মানে সবই কি আগে থেকে ঠিক করা? আমরা কি চালিত হচ্ছি? এই স্ক্রিপ্ট আগে থেকেই লেখা ছিলো। শুধু...
একটা খট খট আওয়াজে চোখ খুলতে হলো। দৃষ্টি চলে গেল কাপটার দিকে। ওটার মধ্যে কেমন একটা স্পন্দন দেখা যাচ্ছেনা? যেন সেটা একটা ইঁদুরের মতো জীবিত কিছু।
- সোহম, তুই কি এসেছিস?
জিজ্ঞেস করলাম খুব কষ্টের সাথে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
কাপের ঠকঠকানি আরো বাড়তে লাগলো। আমরা বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রাঙ্কের উপরে সেটা প্রায় নেচে বেড়াচ্ছে এখন।
- সোহম, সোহম তুই কি এসেছিস? তুই এসে থাকলে হ্যাঁ লেখাটার উপর কাপটাকে নিয়ে আয়।
বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কথাগুলো আমি নিজে বলছি। কোন সন্দেহ নেই যে আমাকে এখন চালিত করছে অন্য কেউ। হয়তো আমাদের সবাইকে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে কিন্ত কিছু করার নেই আর।
কাপের ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর সেটা আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো হ্যাঁ এর দিকে। কিন্ত একি? মাঝখানে রাস্তা পালটে সেটা না এর দিকে যাচ্ছে কেন? তাহলে কি সোহম আসেনি? প্ল্যানচেট করার সময়ে অনেক সময় এমন আত্মা চলে আসে যে অবাঞ্ছিত । এটা খেয়াল ছিলোনা আমার। সে রকম কিছু নয়তো? এবার কি হবে? বারবার চেষ্টা করলাম সরে আসতে। চেষ্টা করলাম কাপটাকে আছড়ে ভাঙতে। কিন্ত একটা ইঞ্চি নড়তে পারলাম না। বাকীরা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেন? কেন? ঠিক এই সময় দেখলাম ঘরের দেওয়ালে নতুন আরেকজনের ছায়া পড়েছে। সাত নাম্বার ছায়া। কিছু বুঝতে পারার আগেই একটা শরীর আমার পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো মোমবাতিটার উপর। সঙ্গে সঙ্গে শনশন করে হাওয়া বয়ে গেলো আর চারিদিক ঢেকে গেলো অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের ভেতরে মহা আতঙ্কে দেখতে পেলাম....।
না:। কিছুই দেখতে পাইনি। কোন ঘটনাই ঘটেনি। কোন প্ল্যানচেট করিনি আমরা। ভেবেছিলাম করবো। মোমবাতি একটা ছিল। লোডশেডিং ছিলোনা,তবে ঘর অন্ধকার করে বসার ইচ্ছে ছিলো। কিন্ত এইসব কথাবার্তা হওয়ার সময়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সন্দীপ হঠাত লাফ দিয়ে নেমে এসে আমার হাত থেকে মোমবাতিটা কেড়ে নিয়ে মটমট করে সেটা ভেঙে ফেলে জানালা দিয়ে বিসর্জন দিয়ে আবার কম্বলে গিয়ে সেঁধোয় আর আমাদের প্ল্যানচেট করার আশা সেখানেই ধুক করে নিভে যায়।
আমরা কোন প্ল্যানচেট করিনি।
কেয়ারটেকারও বদল হয়নি সেই রাতে।
সোহম হালদার বলে কেউ ছিলনা।
বেশ,হোক শুরু। তবে মাথায় রাখতে হবে,যে এর মধ্যে এমন অনেক ঘটনাও থাকবে,যা অনেক বন্ধুই জানবে না,কারন বন্ধুত্ব স্কুলতুতো,কোচিংতুতো,ফ্ল্যাটতুতো, পাড়াতুতো ইত্যাদি নানা গোত্রের হতে পারে কিনা,তাই।
যাদের গপ্পো বলা হবে তারা সকলেই বাস্তব চরিত্র এবং ঘটনা গুলিও ঘোর বাস্তব। সুতরাং যেকোনো রকম মিল সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে,যে কারুর কাছে কোন দু:খপ্রকাশ করার দায় নেই আমার।
বন্ধু চল ১
মিশন শান্তিনিকেতন
এ হলো সেই সময়ের কথা,যখন আমরা স্কুল লাইফের বাধোবাধো ভাব ছেড়ে কলেজ জীবনের উদ্দামতায় ঢুকে পড়ে নিজেদের যথোচিত লায়েক মনে করছি। যদিও সত্যি হলো,যে বিদ্যালয় জীবনের ভীরুতা গা থেকে তখনো খসে পড়েনি - অর্থাৎ ফার্স্ট ইয়ার। ঠিক এই কারনেই বেড়াতে যাবার প্ল্যান করার সময়ে সবার আগে মনে পড়ে গেছে স্কুলে পড়া আর কোচিং বন্ধুদের,যাদের হয়তো কলেজ আলাদা কিন্ত স্কুল বন্ধুত্ব অটুট। আমাদের পকেট তখন নিউটাউন action plan 3- অর্থাৎ ইতিউতি ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স হলেও অধিকাংশই ফাঁকা মাঠ। কিন্ত মেজাজটাই তো আসল রাজা - তাই টাকাকড়ি কম থাকলেও ডোন্ট কেয়ার।
ক্রীশমাসের ছুটি। কোথাও বেড়াতে না যাওয়াটা একটা পাপ। কিন্ত একইসাথে দৃশ্যসুখ আর পকেটের সুখ উপভোগ করা যেতে পারে এমন কোন জায়গা আছে কি? সিগারেট কিনতে দশ কিলোমিটার ঠ্যাঙাতেও হবেনা,আবার গায়ে ঘষটানো ভীড় ঠেলতেও হবে না সারাক্ষণ,এই জাতীয় কোন মোকাম? ভাবনাচিন্তা করে দেখা গেলো : আছে আছে স্থান!! সেখানে পৌষমেলার মোচ্ছব। সেখানে বিদুষী মামনিদের হাট। সঙ্গে ফাউ হিসেবে চনমনে ঠান্ডা আর খোলা আকাশ। বাবা তখন সদ্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, মানে থাকার খরচা নেই। সেবারের ছুটিতে তাই ঠিক হলো, যে বাঙালী সংস্কৃতির এই মদিনায় আমাদের দিগ্বিজয় সাধিত হবে।এরপরে আর কি? "আয়ায়ায়া আমাদের শান্তিনিকেতন" বলে নাচতে নাচতে ট্রেনে উঠে পড়ার শুধু অপেক্ষা।
( আমার কেন জানি না বহুদিন ধারনা ছিলো যে এই গানটা তোতলাদের জন্য লেখা, যাতে ফার্স্ট লাইনে আটকে গেলে সেটা ম্যানেজ করা যায়)।। আমি দুদিন আগে চলে গেছি বাবা মায়ের সাথে। বন্ধু ব্রিগেড আসবে আমার পিছু পিছু। নামবে প্রান্তিকে ( বোলপুরের পরের স্টেশন) কারন সেখান থেকে ফ্ল্যাট চত্বর হাঁটা পথ। জনা ছয়েক সদ্য ভোটাধিকারপ্রাপ্ত অত:পর দিন দুয়েক বাবা মা সম্মিলনে ভদ্রসভ্য থেকে, তাঁরা কলকাতা প্রস্থান করলেই নিজমূর্তি ধারন করবে। সমস্ত পরিকল্পনা ঠিকঠাক, কিন্ত হায়। রবিঠাকুরের ঠেক যে শুরু থেকেই তাদের প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করবে, সে কি কেউ ভাবতে পেরেছিলো আগে?
বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার যখন প্রান্তিক স্টেশনের হাতায় এসে দাঁড়ালো, শীতালি রোদ্দুর সবে ছোট্ট কাঁচামাটির প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। আমি শাল মুড়ি দিয়ে বন্ধুদের অভ্যর্থনা করবো বলে দাঁড়িয়ে। বীরদর্পে একে একে নামলেন তারা। অনির্বাণ, সন্দীপ,শান্তনু, সৌম্য,বান্টি এবং মৈনাক। সকলের মুখেই চওড়া হাসি,আমিও বেশ একটা রাশভারী হোস্ট ভাব নিয়ে " আয়,আয় কোন কষ্ট হয়নি তো" ভাব করে এগিয়ে গেছি - এমন সময়ে মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন একটি কালো কোট।
বোঝা উচিত ছিলো। অবশ্যই বোঝা উচিত ছিলো বন্ধুদের,যে বোলপুর অব্দি টিকিট কেটে প্রান্তিকে নামা একটা রিস্ক ফ্যাক্টর। আমারও সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিলো,যে মেলার সিজনে জায়গাটা এক্কেবারে ক্ষুধার্ত হায়নায় ভরে আছে,কারন বহু লোক টিকিট না কেটে এই প্রান্তিকেই নামছে আশ্রমের দূরত্ব যেহেতু এদিক দিয়ে কম। কিন্ত ওই যে - ফার্স্ট ইয়ার।
বন্ধুরা অবশ্য তখনো অকুতোভয়। বুক ফুলিয়ে এগিয়ে দেওয়া হলো টিকিটের তাড়া। কালো কোট তার উপরে একবার তাকালেন। চোখে মুখে ফুটে উঠলো কেমন একটা কসাই কসাই ভাব। তারপর সেই টিকিটের থেকে ক্রুর দৃষ্টি তুলে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন : এ তো বোলপুর অব্দি কাটা আছে। তোমরা তো বোলপুর ছাড়িয়ে এসেছো।
বন্ধুদের মাথায় ব্যাপারটা তখনো, যাকে বলে register করেনি। কিন্ত আমি বুঝেছি। এবং সেই সাথে এটাও বুঝেছি, যে বিনা প্ল্যাটফর্ম টিকিটে ঘোরাঘুরি করছি বলে আমাকেও পাকড়াও করা হতে পারে। তাই " শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ" পোজে একটু সাইডে সরে গেলাম।
কালো কোট আর সময় নষ্ট না করে বললেন : একশো পঁচিশ টাকা।
বন্ধুদের মধ্যে "স্মার্টবয়" অনির্বাণ( সেই একমাত্র ফ্রেঞ্চকাট রাখার স্তরে উন্নীত হয়েছে,বাকী সবার তখনো স্কুলকালীন সেই বন্য গোঁফ সম্বল) পালটা ভাও দেখিয়ে " আপনি রসিদ কাটুন, আমরা দিয়ে দিচ্ছি " গোছের একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কালো কোট মেসির মতো নৈপুণ্যে তার কনফিডেন্সকে ডজ করে জালে বল ঢুকিয়ে দিয়ে বললো :
"একশো পঁচিশ। each. "
আগামী সাতদিনের জন্য তখন প্রত্যেকের পকেটে বরাদ্দ তিনশোটি টাকা। তার মধ্যে খাওয়াদাওয়া আছে, সিগারেট আছে,ঢুকুঢুকুর প্ল্যান আছে,ভ্যান বা রিক্সাভাড়া আছে এবং ফেরার টিকিট কাটতে হবে সেই টাকা থেকেই। এখন পকেট থেকে একশো পঁচিশ বেরিয়ে গেলে ঢুকুঢুকু এবং অন্যান্য বিলাস তো দুরস্থান, শেষ দুদিন হয়তো না খেয়েই...!!!
কালো কোট তখন বন্ধুদের চোখে মোটামুটি ভারতভাগ্যবিধাতা। অতএব প্রায় সমবেত আর্তনাদ সহকারে তার উদ্দেশে আকুল প্রার্থনা আর অনুনয় বিনয়ের বন্যা বয়ে গেলো। এর ফলে তিনি যে কয়েকটি তাজা কিশোরের অনাহারে মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন, সেটাও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হলো একইসাথে। কালোকোট অবশ্য হীরক রাজার মতো নিষ্ঠুর নন, যে বলে উঠবেন : অনাহারে নাহি খেদ/ বেশী খেলে বাড়ে মেদ। তাছাড়া তিনি এটাও বুঝতে পারলেন, যে এই ছেলেগুলির থেকে খুব বেশী টাকা বের করা,আর দাউদ ইব্রাহিমকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রায় একই লেভেলের উদ্যোগ। অতএব যথোচিত কাঠিন্যে শুধু একজনের ফাইনের টাকা অর্থাৎ একশো পঁচিশ নিয়েই তিনি আমাদের রেহাই দিলেন। সবাই মনের মধ্যে অল্পবিস্তর মেঘ নিয়ে স্টেশন ছাড়লো। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেটা কেটে যেতে অবশ্য বেশী সময় লাগলোনা। ইতিমধ্যে আমরা দুটি প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি।
এক :যাই হোক আর তাই হোক - রিক্সা কিম্বা ভ্যান চড়া চলবেনা। পুরোটাই পা গাড়ির উপর ভরসা রেখে এগোতে হবে, সে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন।
দুই : সিগারেট খাওয়ার বিলাসিতা পরিহার করো। ফিরে এসো দেশজ শিল্পে, অর্থাৎ বিড়িতে। যার কাছে যা অবশিষ্ট সিগারেট আছে খরচ হলেই আমরা " কোন পুরাতন প্রানের টানে" গাইতে গাইতে বিড়িতে টান দেবো।
কোন ব্র্যান্ডের বিড়ি সবচেয়ে সরেস,সেই নিয়ে উচ্চাঙ্গের আলোচনা হতে হতে ( এই ব্যাপারে দু একজনকে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ দেখা গেলো,মানে আন্তর্জাতিক বিড়ি সম্মেলনে তারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেই পারে) কখন যে ফ্ল্যাটের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছি খেয়ালই নেই। এখন থেকে আমরা একেকটি আদর্শ ছাত্রের প্রতিমুখ। প্রথমেই একটি বাওয়ালের ঝাপ্টা কাটিয়ে উঠে আমরা তখন আশা করছি যে সামনে শুধুই বিশুদ্ধ ফুর্তির দিন।
কিন্ত তখন কি জানতাম, যে কত অন্ধকার এবং আলো অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য?
গুরুদেবের দেশে আমাদের পরবর্তী কীর্তিকলাপ বলবার আগে এটা জেনে নেওয়া ভাল,যে এত্তগুলো ছেলের থাকার ঠাঁই কি ভাবে হয়েছিলো।
আগেই বলেছি, বাবা প্রান্তিকের কাছে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। বেঙ্গল পিয়ারলেসের করা " সোনার তরী " নামের আবাসনের প্রান্তদেশে এক বেডরুমের তিনতলা। পজিশন দুর্দান্ত, কারন সামনেই আবাসনের পাঁচীল,তার ওপারে লালমাটি চিরে চলে গেছে একটি জলধারা। সেখানে ছেঁড়াখোঁড়া জঙ্গল। রাখাল গরু, ছাগল চরাতে আসে। খালের ওপারে সীমান্তপল্লীর ছায়াঢাকা গ্রাম। ছাদে উঠলে বাঁদিকে তাকালে প্রাচীন রেলব্রীজ,যেখান দিয়ে ট্রেন যায় হাতছানি দিয়ে। ডানদিকে তাকালে সরু পীচ রাস্তা বাঁক নিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। ওই রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই সোনাঝুরির জঙ্গল,অর্থাৎ খোয়াইয়ের ধার।
এই কাব্যিক পরিবেশের মধ্যে সাত সাতটি খোক্কসের উদয় হওয়ার পরে যা হবার তাই হয়েছে। দুপুরবেলা কাছেই একটা খাবার জায়গায় একপেট করে গেলার পর সেই রেস্টুরেন্টের লোকেরা তালাচাবি লাগিয়ে চলে গেছে। শান্ত নিস্তব্ধ আবাসনে কাওতালি আর হররার চোটে লোকাল কাক শালিকেরা কেটে পড়েছে।এবং কোন ফ্ল্যাটের কোন তলায় কি ধরনের ললনা বিরাজ করছেন, তৈরি হয়ে গেছে সেই ম্যাপ।
যাই হোক, যে প্রসঙ্গে এত কথার ত্যানা প্যাঁচানো। সাতটা দামড়া ছেলের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটের মধ্যে আরামসে থাকার রহস্য এবার খোলসা করি।
হিসাবটা খুব সোজা।
১) ঘরে মিনিমাম সময়ের উপস্থিতি। সারাদিন বাইরে টো টো করে ঘুরে হাল্লাত হয়ে বাড়িতে এসে,আবার দু ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে যাওয়া। শীতের শান্তিনিকেতনে চার দেওয়ালের মধ্যে যে থাকে তার চেয়ে দুর্ভাগা কেউ হতেই পারেনা। আমরা তেমন নই,তাই হরবখত ফ্ল্যাটে গরুর হাটের হট্টগোলও নেই।
২) শোয়ার জন্য বারোয়ারি বিছানা।
একটা লম্বালম্বি গদি। তার ওপর পরপর বালিশ। ধুমশো একটা কম্বল। শুয়ে পড়ো এবার। কার বালিশ কোন মাথায়,কার ঠ্যাঙ কোনদিকে ,সব গুলিয়ে একাকার। এভাবেই জড়াপুটলি করে খিকখিক খৌ খৌ করে রাত কাবার হয়ে যেতো।এখন তিন চার বা পাঁচতারা হোটেলের বাসিন্দাদের সেইসব যৌথশয়ন মনে আছে কিনা,কে জানে?
আমাদের এই অভিযানের দ্বিতীয় কিস্তিতে নায়ক যদি কেউ থেকে থাকে, তো বান্টিসোনা ওরফে সুমিত। সেই গল্পটাই বলবো এবারে।
কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরার কারনে সকলেই কম বেশী ক্লান্ত সেদিন। দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে একে একে লম্বা হওয়া গেলো ফরাসের ওপর। একটু খানি গড়িয়ে নিয়ে চরতে বেরোনো হবে। বাবা মা বেডরুমে আছেন,আমরা সব বাইরের হলঘরে অধিষ্ঠিত। আমাদের মধ্যে দু তিনজন ভালোমতো সিগারেট খোর হয়ে উঠেছে ফার্স্ট ইয়ারেই,সুতরাং তারা শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে সিগারেটে সুখটান দিয়ে চাদরের তলায় ঢুকেছে।
শীতের বেলা দেখতে দেখতে ঢলে পড়ে। সেদিন পরিকল্পনা ছিলো খোয়াইয়ের হাটে যাওয়ার। সেইমতো আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়েছি। চাদরের তলায় সিগারেটের প্যাকেট লুকানো আছে। বাবা এক্ষুনি বেরোবেন ঘর থেকে। তাই সব ধামাচাপা দিয়ে ভালোমানুষের মতো সবাই ফরাসের উপরে বসে। মধ্যমনি হয়ে বান্টি। বাবা বেরোলেন। আমাদের পরিকল্পনা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা বললাম। মৈনাক তখনো নাক ডাকছিলো। লোকজনের গলার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙবো ভাঙবো অবস্থায় আসায়, সে একটা " ঘোঁত " আওয়াজ করে পাশ ফিরলো,সঙ্গে চাদরটাও নিজের গায়ের ওপর জড়িয়ে নিলো অক্লেশে। আমাদের যাবতীয় গোপনীয়তা উন্মুক্ত করে সিল্ক কাটের প্যাকেটটা জ্বলজ্বল করে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। ঠিক বান্টির সামনে। বাবা সেদিকে তাকালেন। আমরা সেদিকে তাকালাম। বান্টি এক গাল হাসি নিয়ে তাকালোনা। এইজন্যেই ওকে বান্টিসোনা বলে ডাকা হোত। বাবা হাসলেন। বেরিয়ে গেলেন। আমরাও হাসিতে ফেটে পড়লাম। বান্টি এবারে সেদিকে তাকালো। ওর হাসি নিভে গেলো।
কিন্ত এতেই যদি বান্টির ভোগান্তি শেষ হতো, তাহলে আমি ছেলেটাকে এ পর্বের নায়ক করতাম না।
কিছুক্ষন পর। আমরা বেরিয়ে পড়েছি হাটের উদ্দেশ্যে। ফ্ল্যাট থেকে হাট চত্বরে পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট কুড়ি মতো। পা গাড়ি চলছে বনবন। বেলা ঢলে পড়েছে, আর শিরশিরে একটা হাওয়া ভেসে আসছে খালের উপর দিয়ে। আমি,সন্দীপ,মৈনাক এবং সৌম্য ধোঁয়ার উত্তাপে সেই ঠান্ডাকে সরিয়ে দিচ্ছি। বান্টি খাবেনা। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন,অর্থাৎ দলে এতগুলো ফুঁকো থাকা সত্বেও সে কেস খেলো কেন, এই অভিমানে " দাম দিয়ে যন্ত্রনা" কে সে দূরে সরিয়ে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রাম্য চৌরাস্তায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। এই মোড়ের বাঁদিকে দশ মিনিট হাঁটলে আশ্রম,ডানদিকে গোয়ালপাড়া গ্রাম, সোজা হাঁটলেই সোনাঝুরির জঙ্গল তথা খোয়াইয়ের হাট। অনেক সাধ্য সাধনার পরে বান্টি রাজি হলো সিগারেটে চুম্বন দিতে। শীত আরো জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে হাতে সিগারেট না থাকলে ঠান্ডা কাটবে কি করে?
আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের ফোঁকা শেষ। এখন শুধু বান্টির মুখে ধোঁয়া। সুখটান। প্যাঁক প্যাঁক শব্দে রিক্সার ঝাঁক আসছে যাচ্ছে। হাটুরে লোকেরা ঘোরাঘুরি করছে। ছাগল ছানা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে,পেছনে ন্যাংটো খোকা ততোধিক লাফাচ্ছে। রাস্তার ধারে দোকানে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। ডিমভাজার গন্ধ। বান্টির মেজাজ শরীফ। এখান থেকেই আমরা মেলায় যাবো। সেখানে কি কি হতে পারে আর না পারে সেই নিয়ে সবাই উত্তেজিত। দূর থেকে একটা রিক্সা আসছে। বান্টির মুখে আবার সেই ভুবনভোলানো হাসি ফিরে এসেছে। রিক্সা আরো কাছে চলে এসেছে। বান্টির মুখে সিগারেটের কমলা সুখ। রিক্সার উপরে বাবা।
বাবুরা এবং বিবিরা - এইবারে ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে আস্তে আস্তে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপার স্যাপার উঁকি মারতে শুরু করবে । সেই জন্যআগেই "U/A" মার্কা বোর্ড টাঙিয়ে দিলাম। একটু বুঝেশুনে দরজা খুলবেন।
সকাল। শীত। কুয়াশা। শিশির।
বাবা মা ভোরের ট্রেনে কলকাতার দিকে ফিরতি পথ ধরেছেন। কোনক্রমে তাদের দরজা খুলে দিয়ে আমি আবার ফরাসের উপর লম্বা হয়েছি। চোখে ঘুম নেমেছে সাড়ে তিনটের পর। আয়ায়ায়াহ..ধুত্তেরি!!! হতভাগা শান্তনুর দামড়া লাশটাকে পাশবালিশ ভেবে জড়াতে যাচ্ছিলাম। সে ঘুমের মধ্যেই একটা কাঁচা ছাড়লো। সারারাত হ্যা হ্যা করে দাঁত কেলিয়ে এখন ব্যাটা নাক ডাকাচ্ছে। কিক্কেলো রে বাবা। প্রায় মমি পোজে খানিকক্ষন শোয়ার চেষ্টা করলাম। ধুসসসস।
কটা বাজে এখন? ঘড়ি জানালার তাকে। সৌম্যকে খোঁচা দেওয়া যাক একটা। শালা মরে গেলো নাকি!!!
- ইরিবাবায়ায়া। কি ঠান্ডা!!! শালা এ শান্তিনিকেতন না দার্জিলিং।
বলতে বলতে সন্দীপ উঠে পড়লো। আমি এক দৌড়ে বাথরুমে।পটি পটি ভাব হচ্ছে একটা। এইসব মালেরা একবার উঠে পড়লে বাথ্রুমে যাওয়া ভোগে। ন্যাট জিয়োতে কুমীরের বাসায় ডিম থেকে বাচ্চা বেরোনো দেখেছেন কখনো? পাঁচ মিনিটের মধ্যে একে একে সবাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে এবার,ঠিক সেই স্টাইলে। প্রায় একসাথেই। সেইসময়ে আমরা শোয়া বসা খাওয়া ঘুম প্রায় যৌথ ভাবেই পালন করতাম কিনা।
ফ্রেস হয় যখন বেরোলাম, জনতা তার মধ্যে হেবি চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। অনির্বান ভেতরের ঘরের বিছানায় আবার লম্বা হয়েছে,আর সবচেয়ে মোলায়েম বালিশটা দখল করেছে। বান্টি সেই বালিশ টানাটানি করছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সংসারী সন্দীপ গম্ভীর মুখে চায়ের জল চাপাচ্ছে। মৈনাক আর সৌম্য কালকে কেনা একটা বিড়ির প্যাকেট থেকে দু পিস বার করে তরিবত করে টানছে আর মাঝে মাঝেই জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে বলছে : শালা কি কষটা মাইরি। শান্তনু চূড়ান্তভাবে ফরাস আঁকড়ে ঘুমোচ্ছিল। সে যে কিভাবে পাঁচ পাঁচটা ডিফেন্ডারকে মারাদোনাসম ডজ করে বাথরুমে ঢুকে পড়লো,সে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য!!! কেউ কিছু বোঝার আগেই ধাঁই করে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, আর হেঁড়ে গলায় শোনা গেল গান : আরে চাঁন্দ সিতারে ফুল অর খুসবুউউউউ...।
- শালা খুসবু বলে টানটা দিচ্ছে দ্যাখ। ছাদ টাদ ভেঙে না পড়ে। " অনির্বান ঠ্যাঙ দোলাতে দোলাতে বললো।
- ওরে, কাল বারন করেছিলাম ডিম না খেতে। খুসবু তো দরজা ভেদ করে বেরোচ্ছে এবার।" সৌম্যর ফোড়ন।
সন্দীপ " চা গুলো নে, বেবুনের দল " বলে সবেমাত্র হাঁক পেড়েছে,ঠিক এমন সময়ে...।
কোত্থেকে যেন একটা রিনিরিনি হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে না? চুড়ির রুনুঠুনু? মধুর পদসঞ্চার?
আমরা সবাই দুদ্দাড়িয়ে জানালা দিয়ে, বারান্দা দিয়ে,ঘরের দরজা খুলে দেখতে শুরু করলাম। সৌম্য আর না পেরে ছাদের দিকে চলে গেলো। আমাদের সেই বুভুক্ষু দশা দেখলে জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর গুলোও লজ্জা পেতো সেদিন। শান্তনু ততক্ষনে " হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ " গাইতে গাইতে গাইতে নিজেকে হৃতিক রোশন না হোক,রসুন অব্দি ভেবে ফেলেছে। অনির্বান তাকে তিন খিস্তি দিয়ে বললো : কাকায়ায়ায়া। মামনিইইইইই। চুউউপ। কাকা চুপ করলো আর তিন মিনিটের মাথায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে " কই, কই শুরু করলো। "
আমরা যখন এইভাবে দাপাদাপি করছি,সন্দীপ তার শকুনের চোখ দিয়ে খুঁজে বের করলো সেই এল ডোরাডো। আমাদের ফ্ল্যাট হচ্ছে টপ ফ্লোরে। সেই ফ্ল্যাটের বেডরুমের জানালার ঠিক নীচে একটা দোলনা। সেখানেই আবির্ভূতা হয়েছেন লাল সোয়েটার গোলাপী সোয়েটার পরে দুজন পরী ( পরে আবিষ্কার করা হয়েছিলো,এই দোলনাটি একইসাথে আনন্দ আর মাথাব্যথার জোগান দিতে পারে। প্রচুর রমণীয় কমনীয়দের মেলাও যেমন দেখেছি,গাদা বাচ্চাদের চ্যাঁ ভ্যাঁও সহ্য করতে হয়েছে)। আমরা জানালা দিয়ে একে আরেকজনকে টপকে তাদের দেখার চেষ্টা করছি,দেখি অনির্বাণ আর সন্দীপ ধড়াচূড়া পরে রেডি!!!! কি ব্যাপার?
- কোথায় যাচ্ছিস ভাই?
বান্টির সরল প্রশ্ন।
- যাইহ। মেয়ে গুলোর সাথে একটু আলাপ করে আসি। অনির্বান তুই কোনটাকে নিবি? সন্দীপ নিরাসক্ত ভাবে বললো।
আমরা তো পুরো হুব্বা!!! ইলেভেন টুয়েলভে স্কুল আর কোচিং এবং ফার্স্ট ইয়ার - এই হচ্ছে আমাদের মেয়ে চেনার দৌড়। নিজে থেকে যেচে কারো সাথে আলাপ করতে যাওয়া, অন্তত আমার কাছে,একটা অকল্পনীয় কেস ( সত্যি বলতে কি,আমি এখনো সেটা পারিনা। কেমন যেন জিভ শুকিয়ে যায়,হাত ঘামে আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ বের হয়। একবার একটি মেয়ে আমাকে retarded ভেবে অনেক সহানুভুতি দেখিয়ে ছিলো।)
অনির্বাণ দেঁতো হেসে বললো : কি রে, আর কেউ যাবি?
আমরা সবাই তখন বিশাল একেকজন আদর্শবাদী। " এইভাবে যেচে কারু সাথে আলাপ করিনা ", " মেয়ে গুলো হ্যাংলা ভাববে" থেকে শুরু করে বাঙলার যুব সমাজের অবক্ষয় নিয়ে একটা কঠিন ভাষণ শুরু করা যায় কিনা ভাবছি - সন্দীপ আর অনির্বাণ আমাদের আঙুর ফল টক আর নিতে না পেরে " তোরা বসে বসে ছেঁড় " বলে গটমটিয়ে নীচে নেমে গেলো। আমরা আবার গ্যালারীতে ফিরে এলাম। একটু পরেই দেখি গুটি গুটি দুই মক্কেল রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। এমন একটা হাবভাব যেন স্বর্গের উদ্যানে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে দুটো দেবদূতের বাচ্চা। মেয়ে দুটো ওদের দেখে কিছুটা সংযত। নীচ থেকেই শুনতে পাচ্ছি সন্দীপ বললো : গুড মর্নিং। দোলনায় বসে থাকা মেয়েটা প্রত্যুত্তর দিলো। আমরা ওপর থেকে খিক খিক করে হাসলাম।
নীচে কথাবার্তা চলছে। সন্দীপ নানা রকম বোলচাল দিচ্ছে। অনির্বানও কম যায়না। মেয়েগুলো কোন ফ্ল্যাটে উঠেছে থেকে শুরু করে বাড়িতে কে কে আছে, কোলকাতায় কোথায় থাকা হয়,কোথায় পড়া হয় ( সন্দীপ জেভিয়ার্সে পড়ে শুনে মেয়েদুটো খুবই ইম্প্রেসড। অনির্বাণও তাই জাভেরিয়ান হয়ে গেলো,যদিও সে টেকনোর পোলা)। বকবকমের মাঝে অনির্বাণ আঙুল দিয়ে আমাদের দেখালো, আমরাও হেঁ হেঁ করে হাত নাড়লাম। তারপর সন্দীপ হাল্কা করে কিছু একটা বলাতে মেয়েদুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।
- নির্ঘাত কান ভারী করছে। মৈনাক গরগর করে বললো।
- কি বলছে বলতো? সৌম্য উত্তেজিত ভাবে একটা বিড়ি ধরিয়েছে।
- বলছে নিশ্চয় আমরা সব আবোদা ছেলেপুলে, মেয়ে দেখলে প্যান্টে হিসু করে ফেলি।
- শালা শুয়োর।
শান্তনুর খেদোক্তি।
বান্টি চিন্তিত ভাবে বললো - এসব গপ্প দিলে তো মুশকিল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে তো মেয়ে গুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতেই পারবোনা।
- ওপর থেকে এক বালতি জল ঢেলে দিলে কেমন হয়? আমার সুচিন্তিত পরামর্শ।
- হে হে, তার চেয়ে সৌম্য, তুই বরং বিড়িটা সন্দীপের টাক বরাবর...
শান্তনুর কথা শেষ হতে পেলো না,কারন সকলেই হাঁ হাঁ করে উঠেছে। এই মাগগিগন্ডার বাজারে একটা বিড়িও বহুমূল্য। শান্তনু এ রসে বঞ্চিত, তাই এত সহজে কথাটা বলতে পেরেছে,নয়তো প্রাণে ধরে এমনটা ও করতে পারতো কি?
আমরা পরস্পর এই সমস্ত বিষাক্ত আলোচনা করছি,এমন সময় মেঘ না চাইতেই জল।
তাড়াহুড়োতে বেরিয়ে যাওয়ার কারনে ছেলেদুটো খেয়াল করেনি বাইরের টেম্পারেচার কতটা নির্মম হতে পারে। সকাল সাড়ে সাতটাতেও বাঘা শীত জাপ্টে রেখেছে শান্তিনিকেতনের সর্বাঙ্গ। এর মধ্যে সন্দীপ আবার একটু সুখী প্রাণী। ঠান্ডা গরম একটু এদিক সেদিক হলেই কাতর হয় পড়ে। কলকাতা থেকে সে একটা বাহারী কানঢাকা টুপি নিয়ে এসেছে,আর সূর্য ডুবলেই সেটা পরে ফেলছে। এই তুরীয় মুহুর্তে আমাদের টুপি ফুপির কোন খেয়ালই থাকতো না,কিন্ত সে আবার খুব হিসেবী মানুষ, সব টিপটপ হওয়া চাই।
অতএব,
- ওইইই। আমার টুপিটা একবার দে তো।
নীচ থেকে আমাদের উদ্দেশ্য করে তার হুকুম ভেসে এলো।
সকাল সকাল পেটে কিছু পড়েনি। এইসব কান্ডের মধ্যে চা জুড়িয়ে জল। তারপর ওই মেয়ে দুটোর কাছে আমাদের চরিত্র ফুল গ্যামাক্সিন। এর পরে টুপি!!! বারুদে যেন বিড়ি পড়লো একটা।
মৈনাক একটা ক্রূর হাসি দিলো। তারপর জানলার কাছে গিয়ে মধুক্ষরা কন্ঠে বলে উঠলো - কার টুপি রে? তোর,না তোর ভাইয়ের?
প্রথমে পাঁচ সেকেন্ডের নীরবতা। সন্দীপ চুপ। অনির্বান চুপ। মেয়েগুলো মাথা নীচু করে চুপ। একটা কাঠবেরালি সামনের সজনেগাছে ডাকাডাকি করছিলো। সেটা পর্যন্ত স্পিক্টি নট।
তারপরে হা হা হি হি খুঁ খুঁ খৌয়া খৌয়া!!
শান্তনু হাসতে হাসতে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলো।
এরপরে সন্দীপ আর অনির্বাণের বুক ভরা আশা যে ধুক করে নিভে গিয়েছিলো, সেটা আশা করি বলে দিতে হবেনা। কিছুক্ষন পরে ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ওরা আমাদের কি বলতে পারে তার জন্যও কোন প্রাইজ নেই। তবে মেয়েগুলোকে আর ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। আমার ধারনা, সেদিনই ওরা শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে।
সেই আমল? সেই আমল মানে? রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আপনারা কি co founder?
হেঁ হেঁ। চটছেন কেন। না মানে,এই বছর পনেরো আগের কথা।
বছর পনেরোওওওও!!! তখন ওখানে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো বুঝি?
এই দেখুন,আপনি আবার চটে যাচ্ছেন। হ্যাঁ মশাই, মাত্র পনেরো বছর আগের কথা। তবে এরই মধ্যে শান্তিনিকেতনের নানারকম ছোট বড় এদিক ওদিক যা হয়েছে, সেটা ব্যক্ত করতে বড্ড ছটফটানি লাগছে হঠাত। তাহলে শুরু করি? না না, এই দু চারটে ফারাকের পাঁচালী। বেশি সময় নেবোনা।
সেকাল এবং একালের মধ্যে প্রথম, এবং প্রধান যে ফারাকটা চোখে পড়ে,সেটা হোলো হুজুগে পাবলিকের ভীড়। এটা তখনও ছিলো। কিন্ত এত বীভৎস ছিলোনা। এই পিরীতের সাথে একমাত্র পাল্লা দিতে পারে সিগনালে রবীন্দ্রসংগীত বাদনের অত্যাচার। বিশেষ করে দোলের সময়ে যে লেভেলের ভীড় হয়, তাতে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা যখন তখন হয় যেতে পারে। গরদের পাঞ্জাবী ফৌজ আর পৃথুলা আদি ঢাকেশ্বরী বাহিনী মহামারীর মতো পালে পালে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে দোলে, পৌষমেলায়,বা খ্রীষ্টোতসবে ওখানকার মানুষের আনাগোনা গেছে কমে। আমি নিজের চোখে দেখেছি স্থানীয় মৌলবীসাহেব কাঁচের মন্দিরের চাতালে বসে বুঁদ হয় শুনছেন ব্রহ্মোপাসনা। মেলার মাঠে ফকিরি গানের আসরে দেহতত্ত্ব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে একজন সাঁওতাল রমনী। সেইসব দৃশ্য আর দেখা যায়না।
দ্বিতীয় ফারাক দেখা গেছে নিরাপত্তায়।
নোবেল চুরি হওয়ার পর থেকে আশ্রম কতৃপক্ষ " চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে " আপ্তবাক্য বুকের মধ্যে নিয়ে চত্বরটাকে প্রায় জেলখানায় রুপান্তরিত করেছেন। পর্যটকদের মোটামুটি ছাগল চরানোর মতো " এইখানে দাঁড়াবেন না", "ওইখানে বসবেন না", এই দিকে এক ঠ্যাঙে লাফিয়ে চলুন, ওইদিকে মাথা নীচে পা ওপরে করে থাকুন ", বলে জিনা হারাম করে দেবে। ভীড়ভাট্টার সময়ে এদের মুখচোখ দেখে মনে হয় পারলে জনতার ওপরে টিয়ার গ্যাস চার্জ করে। আপনি রিক্সা থেকে নামতে বাধ্য হবেন প্রায় মাইল খানেক দূরে। তারপর খাবি খেতে খেতে হন্টন। সঙ্গে বয়স্ক মানুষ থাকলে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য এখন হয় দাঁড়িয়েছে যে কোন প্রকারে চত্বরের মধ্যে আপনাকে ঢুকতে না দেওয়া। মানে না রহেগা বাঁশ,না বজেগি বাঁশুরি। সেটাই তো সবচেয়ে সহজ। আর আমাদের আমলে? সাতই পৌষ সকালবেলায়, বৈতালিক শেষ হয় যাওয়ার পরে উত্তরায়ন চত্বরে ঢোকার কোন বিধি বাঁধন থাকেনা। উদয়ন, অথবা কোনার্কে আজকাল প্রবেশ নিষেধ। অথচ আমি দিব্যি গায়ে হাওয়া দিয়ে উদয়নের এ ঘর করে বেড়িয়েছি সেদিন। এখন তা শিবের অসাধ্যি। যে অচলাতয়ন ভেঙে ফেলার ডাক দিয়েছিলেন বিশ্বকবি - সেই অযথা নিয়মের নিগড়েই তার প্রিয় শান্তিনিকেতন আজ বাঁধা পড়ে গেছে।
তৃতীয় ফারাক দেখা গেছে উন্নয়নের। প্রথমবার যে প্রান্তিক স্টেশন আমি দেখেছিলাম, সেটা ছিলো লালমাটির একটা বাঁধানো চত্বর মাত্র। এখন আপনি গেলে হাঁ হয় যাবেন। ইয়া ওয়েটিং রুম,ঝাঁ চকচকে প্ল্যাটফরম - কি নেই সেখানে। স্টেশনের পেছনে যে জংলা ডাঙা ছিলো সেখানে মাথা তুলেছে সারি সারি বিষন্ন রেল কোয়ার্টার। প্রান্তিক আজ আধুনিকা। শুধু আমার ছোটবেলার খুদে স্টেশনটা হারিয়ে গেছে। এছাড়াও এদিকে ওদিকে একশো রিসর্ট, দুশো বাড়ি উঠে এখানকার উদার আকাশকে কেমন যেন ভাগাভাগি করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। যে উদার প্রকৃতির জন্যে আমি বারবার ছুটে গেছি,সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয় যাচ্ছে চোখের সামনে। শুনেছি সোনাঝুরির লাল মাটির রাস্তাটাকেও নাকি পিচে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ওই কাঁচা পথের উপরে লাল কাদা কিম্বা ধুলো মেখে অনেক বর্ষা বসন্ত কাটিয়েছি। উন্নয়নের চাপে সেইসব এখন স্মৃতি।
উন্নয়নের দাঁত নখ কিভাবে সারল্য আর সুন্দরকে ধ্বংস করে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় শনিবারের হাট। প্রথম যখন এই হাট বসতে থাকে, আমি সেই সময় থেকেই এর বিবর্তনের সাক্ষী। শুরুর দিকে হাট বসতো প্রকৃতি বীক্ষন কেন্দ্রের ভেতর। এই কেন্দ্রটি বস্তুত কলাভবনের ছেলেপুলেদের করা কিছু বিমূর্ত ভাস্কর্যে ঘেরা। সেখানেই শনিবার দিন জড়ো হতো নানান কিসিমের লোকজন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কাছের গ্রাম থেকে দুজন বউ নিয়ে এসেছে বেগুন, ঝিঙ্গে,লাউ। তার পাশেই এক ফ্রেঞ্চ রমনী বসে গেছেন দুর্দান্ত জিঞ্জার ব্রেড নিয়ে। তার পাশেই হয়তো আবার কলাভবনের কোন থার্ড ইয়ার ছোট ছোট পোস্টকার্ড এঁকে নিয়ে এসে হাজির। বোধকরি গুরুপল্লীর দুই গুরুপত্নী নিয়ে এসেছেন বাড়িতে তৈরি পিঠে। এক বুড়ি কয়েকটা নক্সীকাঁথা আর রঙচঙে পুঁতির মালা নিয়ে বসে গেছে। খরিদ্দার প্রায় সবাই স্থানীয় আর কয়েকজন টুরিস্ট। আড়ালে কয়েক কলসী হাঁড়িয়াও দেখা যাচ্ছে। আপনাকে আশ্রমে যেতে হবেনা। রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবেনা।বিশ্বভারতীর মূল সুর বোঝার জন্য এই হাটে আসাই যথেষ্ট। এ হচ্ছে সেই আমলের কথা। আর এখন? বিশাল বিশাল গাড়ি চেপে বাবু বিবিরা আসেন। তাদের সাথে আসে পেটমোটা বাচ্চার দল। তারা সব রোদচশমা আর বার্মুডা পরে হুমহাম করতে করতে দরাদরি করে। হাটও সরে গেছে অনেক পেছনের দিকে। সেখানে এখন হ্যান্ডিক্রাফটের পশরা যেগুলো প্রায় সবই আপনি পাবেন অন্য জায়গাতে। পার্থক্য খালি এখানে খোলা আকাশের নীচে চলছে কারবার, তাই বেশ একটা ফোকি ফোকি ভাব। পারফর্মিং বাউলরা চলে আসেন সাইকেল নিয়ে। দু একটা চেনা গান করেন। প্যালা পড়ে। বাবুরা ভাবেন, বা: শান্তিনিকেতনের কি এথনিক আবহাওয়া!! এই গোলমালের মধ্যে সেই খ্যাপা বৈরাগী শুধু অদৃশ্য হয়েছে, যার কাছে আমি অসাধারন কিছু গান শুনেছিলাম। হ্যাঁ, ঠিক এই শিমুল গাছের তলায়।
বইমেলায় টিকিট তুলে দিয়ে যে গরুর হাট তৈরি হয়েছে, শান্তিনিকেতনের আজ সেই অবস্থা। তার জলবায়ুর মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন খ্যাপামি ছিলো,তার জায়গা করে নিয়েছে শহুরে বেহুদা কোলাহল। আমরা যে শান্তিনিকেতনে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছি,তার মধ্যে তখনও কিছুটা বেখেয়ালীপনা ছিলো। তাই হয়তো খুচরো খাচরা পাগলামী গুলো করতে পেরেছিলাম। তার কিছু ক্ষনস্থায়ী,কিছু আবার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এখনো জীবন্ত।
এই পর্বটি লেখা শেষ করে আপাতত আমার বকবকমে ইতি টানবো। বন্ধুবান্ধবের কীর্তিকলাপ লিখতে বসলে খাতা বন্ধ করা সত্যিই মুশকিল। কিন্ত সময়াভাবে নিয়মিত বসাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয় দাঁড়াচ্ছে। একটা দায়ভার চেপে বসছে সেই কারনে। আপাতত সেই দায় কাঁধে নিতে আর ইচ্ছে করছেনা। যেদিন ফের মাথায় পোকা নড়েচড়ে বসবে - পেন কামড়ে আবার শুরু করা যাবেখন।
শান্তিনিকেতনে আমাদের নষ্টামির শেষভাগ নানা রঙে রঙীন। তার একদিকে যদি ভৌতিক গা ছমছম, তো অন্যদিকে রোমান্সের গোলাপী প্রজাপতি। কখনো ফুটে বেরোচ্ছে স্বেচ্ছাচারের কালোহাত, আবার অন্যদিকে সাম্যবাদী হাউমাউ। কোনটার দিকে বেশী ফোকাস মারবো সেটাই হলো আসল হার্ডল।
বরং আমাদের " দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান " কাণ্ডকারখানা গুলোই আগে বলা যাক।
হয়তো মনে আছে যে শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই আমার বন্ধুরা ভারতীয় রেলের তহবিলে একশো পঁচিশ টাকা জমা করেছিলেন। স্বেচ্ছায় নয় অবশ্য, করেছিলেন ফাইন হিসেবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হয়েছিলো বলা যায়না,তবে বন্ধুরা প্রায় সর্বহারার পর্যায়ে নেমে এসেছিলেন। এই দুর্ঘটনার কারনে নানাভাবে বাজেট কাটছাঁট করার প্রয়োজন হয় পড়ে,নয়তো সেই শীতকালটা বোলপুরেই থেকে গিয়ে একশো দিনের কাজ টাজে নাম লেখানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকতোনা। বাজেট ছাঁটাইয়ের ফলে প্রথম কোপ পড়ে নেশার দ্রব্যে,অর্থাৎ সিগারেটের হাইওয়ে ছেড়ে বিড়ির কাঁচা রাস্তা ধরতে হয়। দ্বিতীয় কোপ পড়ে পরিবহনে। শান্তিনিকেতনের রাঙা ধুলোয় আমাদের পা বারবার লাঞ্ছিত হতে থাকে,কিন্ত আমরা সাচ্চা সংযম দেখিয়ে রিক্সা বা ভ্যান রিক্সার আকুল আহবান থেকে নিজেদের বিরত রাখি। সেই পাঁচদিনে যে দূরত্ব আমরা চষেছিলাম, তাতে সম্মিলিত ভাবে হয়তো পায়ে হেঁটে কলকাতাই পৌঁছে যাওয়া যেতো। এই ম্যারাথনের ফলে আমাদের অবশ্য খুব একটা হেলদোল দেখা যেতোনা,কারন সামনে যদি লক্ষ্যবস্তু থাকে কোন অষ্টাদশী তো আমরা জাহান্নমেও পাড়ি জমাতে পারতাম তখন। আজ্ঞে হ্যাঁ,একথা অস্বীকার করে আর লাভ নেই,যে মহান কবির কীর্তিস্থলে আমরা কিছু উচ্চ চিন্তা নিয়ে যাইনি,গেছিলাম মূলত মেয়েবাজী করতে। সেটা করতে করতেই কখন যে বিকেল ঢলে সন্ধে হয় রাত্তির গড়াতো, খেয়ালই থাকতোনা। বিকেল চারটে সাড়ে চারটের মধ্যে যথোচিত মাঞ্জা মেরে বেরিয়ে পরা হতো। আমাদের বাড়ি থেকে মেলার মাঠ পায়ে দম থাকলে আধা ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। জনা সাতেক উঠতি জোয়ান পাশাপাশি কলার উঁচিয়ে হাটতাম। তখন " কাঁটে " সিনেমাটা সদ্য রিলিজ করেছে। সেই খলনায়ক গোষ্ঠীর মতো ভাও খেতে খেতে কি যাওয়া আমাদের, সে যদি তোমরা দেখতে!!! এইভাবে মেলা চত্বরে ঢুকে হ্যান্ডিক্রাফটের স্টল থেকে শুরু করে সিউড়ির আচার পেরিয়ে " হরেক চিজ পাঁচ টাকা"র দিকে কান না দিয়ে আমরা বাউল ফকিরের আখড়ায় গিয়ে বসতাম।
স্টেজে তখন একটা লোক তার সপ্তক ছাড়িয়ে ভাবে বিভোর। তার সাথে সঙ্গত করছে যে বাঁশুরিয়া, সেও আগুন ছোটাচ্ছে। হবে নাইবা কেন? মঞ্চের পেছনে তখন নীল নীল ধোঁয়ায় তাজ্জিম মাজ্জিম অবস্থা।এই সমস্ত কান্ড করে যখন পেটের ভিতরে চোঁ চোঁ করতো,আর মেয়েদের ঠ্যাঙের দিকে তাকিয়ে চিকেন তন্দুরীর লেগ পিস মনে পড়তো, আমরা রণে ভঙ্গ দিতাম। খাওয়া দাওয়াতেও একশো পঁচিশ টাকা তার কালো হাত বাড়িয়ে দিতো। আমরা কঠিন মুখ করে রুটি আর ঝালঝাল ডিমের তরকারী খেতে বসতাম এক প্রায়ান্ধকার ঝুপড়িতে। ওই চত্বরে সেটাই সবচেয়ে সস্তা ঠেক। আমাদের পাশে বসে ঝিমোতো ডেইলি বাংলু খাওয়া একটা মাল। পায়ের নীচে একটা লুব্ধ ছাগল ঘুরঘুর করতো। দূরে মেলার হট্টগোল আর আলো ঝুলে থাকতো জমাটি ঠান্ডায়। দুপুরের খাওয়া আরো শস্তায় করা যেতো বিশ্বভারতী ক্যান্টিনে। সেখানে দশ টাকায় রুটি এবং তড়কা পাওয়া যেতো। ক্ষিদের মুখে সবই উড়ে যেতো বটে, তবে এ কথাটা অস্বীকার করে উপায় নেই যে তড়কায় নুনের মাত্রাটা কিঞ্চিৎ বেশি হত আর কি। সত্যি বলতে কি আমাদের চাপাচাপিতে বান্টিসোনা কিচেনে প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিলো এটা জিজ্ঞেস করতে, যে রান্নার ঠাকুর কি তড়কাতে নুন দিয়েছে না নুনে তড়কা দিয়েছে। ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত আর অতোদুর গড়ায়নি,নইলে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ হয়তো অতটা শান্ত আর থাকতোনা। বাড়ি ফিরে দুটি জিনিস করা হতো। এক বালতি জল গরম করে তার মধ্যে পালা করে পা ডোবানো হতো। সেকি অনির্বচনীয় সুখ, আহা আহা!! কোথায় লাগে পাঁচতারা হোটেলের স্পা। সারা সন্ধে হেঁটে এসে সেই আদরের ছোঁয়া নিয়ে আমরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতাম। তারপরে অনির্বাণ মুখে একটা ভিলেনি হাসি টেনে বলতো : বেশ। এবার শুরু করা যাক।
আমরা ফরাসের উপরে গম্ভীর ভাবে বসতাম। একে অপরের মুখোমুখি। যাকে বলে রহস্যের খাসমহল।
সৌম্য ( মৈনাকের দিকে তাকিয়ে) :
- বের কর।
মৈনাক তার জ্যাকেট থেকে একটা কিছু বের করে মাঝখানে রেখে হিসহিসে গলায় :
- এবার তোর পালা।
সৌম্য তার টুপির ভেতর থেকে বের করলো বের করে আনলো আরো মারাত্মক জিনিস। মৈনাকের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
আমি সন্দীপকে বললাম :
- ভালোয় ভালোয় এবার সামনে রাখ যা এনেছিস।
সন্দীপ আমার থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে প্যান্টের গোপন পকেট থেকে যা বের করে আনলো তাতে ঘরের মধ্যে খেলে গেলো হাল্কা শিহরন।
বান্টি মাথা নীচু করে বসে আছে। সে কিছুই আনেনি। তার ভাগ্যে ঝুলছে হয় কুমীর দিয়ে খাওয়ানো,নয় পাহাড় থেকে ধাক্কা। তাকে অবশ্য বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
এবারে অনির্বাণ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একেবারে পেশাদারী দক্ষতায় যা আমাদের সামনে রাখলো, তাতে শান্তনু আর থাকতে না পেরে হাততালি দিয়ে উঠলো : উফহহহহ গুরু গুরু!!!
আমরা সবাই তাকালাম সামনের দিকে। সেখানে আস্তে আস্তে ডাঁই হয় উঠছে কাঠের সিগারেট কেস ( সন্দীপ) নীল রঙের বেড়াল আঁকা চামড়ার বটুয়া ( মৈনাক) ফেঙ শুইয়ের ক্রিস্টাল গ্লোব ( আমি), একটা চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ ( সৌম্য), পাঁপড়ের প্যাকেট ( শান্তনু) আর ইয়াব্বড় একটা টেডি বিয়ার ( অনির্বাণ)।
না:। এর কোনটাই গাঁটের কড়ি ফেলে কেনা নয়। প্রত্যেকটি বস্তু ঝাঁপা। সাহেবী ভাষায় একেই বলে shop lifting। মেলাতে ঘোরার এই আমাদের আরেকটি কারন।
কেন করতাম এরকম? অভাবে স্বভাব নষ্ট? Anti establishment আন্দোলন? গণ ক্লেপ্টোম্যানিয়া? Adventure? এখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করলে এর ঠিকঠাক উত্তর পাইনা। হয়তো এর কোন একটা কারন নেই, প্রত্যেকটাই একটু একটু করে মিশে আছে একে অন্যের সাথে। আমি যে কারনে ক্রিস্টাল গ্লোবটা ঝেঁপেছিলাম,তার কারন ভারী অদ্ভুত। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় বাস্তু এবং ফেং সুই হঠাত পূব দিগন্তে উদিত হয় হুড়মুড় করে ঘাড়ে এসে পড়ে। ঈশান কোনে কাচের ব্যাঙ রাখবেন, না কমোডের উপর জেড পাথরের খরগোস সেই নিয়ে টিভিতে চুলচেরা বিচার করা হতো। আমার এই সব বুজরুকি অসহ্য লাগতো মানে জাস্ট নিতে পারতাম না।ধারনের আঙটি, বেড়াল কাটা, বিপত্তারন মাদুলি, মন্দিরে মানত ফানত শুনলে চিরকাল আমি সেই স্থান এবং সেই লোকের সাহচর্য এড়িয়ে এসেছি। ফেং সুইয়ের উপর আমার আক্রমণ হলো সেই কারনে। আমাদের মধ্যে অন্য কেউ আবার হয়তো নিতো বান্ধবীকে ঝাক্কাস উপহার দেবে বলে। নিছক মজা করার জন্যও যে করা হতোনা, তা বলা যাবেনা। আবার কেউ অতিরিক্ত দামে জিনিস বিক্রি করলে তাকে সহবত শেখানো হতো এইভাবে। এই ঝাঁপা পর্বের, বলাই বাহুল্য,শুরু বা শেষ কোনটাই পৌষমেলায় নয়। তবে হ্যাঁ,একটা জিনিস মাথায় রাখা হতো। এমন কোন জায়গা থেকে ঝাঁপা হতোনা যেখানে দোকানদার নিতান্তই গরীব। অর্থাৎ মেলাতে মাটির উপর বসে যেসব শিল্পী ডোকরার জিনিস বিক্রি করতো,তারা হাঁড়িয়ার নেশায় টঙ হয়ে থাকলেও আমরা সেখানে যেতাম না। শুধু মাত্র বড় দোকানগুলিকেই টার্গেট করা হতো,যাদের পসরার সমুদ্র থেকে দু আঁজলা নিলে খুব একটা কিছু যায় আসবেনা আর কি। অত:পর যার যেমন দরকার সে অদলবদল করে নিতো,নয়তো নিজের জন্যই হয়তো রেখে দিলো। যেমন সৌম্য নিলো সন্দীপের সিগারেট কেস,ওর বাবাকে দেবে। সন্দীপ পেলো চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ তার মায়ের জন্য। ওদিকে অনির্বাণ নিজের কাছেই টেডি বিয়ারটা রাখলো,নাকি প্রেমিকাকে দেবে। ( অমন ধামড়া মাল ব্যাটা হাতসাফাই করলো কি করে সে এক রহস্য!!)। শান্তনু জাতির উদ্দেশ্যে ( মানে আমাদের উদ্দেশ্যে) পাঁপড়ের প্যাকেট দান করলো, আর বদলে পেলো আমার ক্রিস্টাল গ্লোব,কারন ওটা নিয়ে আমি কিই বা করুম? এই হচ্ছে কেস।
এটুকু বলার পর আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যারা এই লেখাটি পড়ছে তাদের চোখে আমরা একাধারে চার্লস শোভরাজ থেকে শুরু করে দাউদ ইব্রাহিম হয়ে হয়তো বা বিজয় মাল্যের মতো কৃতকর্মা হয় উঠেছি। হয়তো তারা আমাদের সাথে সম্পর্কই রাখবেন না। তাদের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে বোধহয় বাটি চামচ গুনে টুনে রাখবেন।পুলিশে হুলিয়া বেরোলেই বা আটকাচ্ছে কে? তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি মোটামুটি কলেজে থাকতে থাকতেই এই কর্মকান্ডে আমরা ইতি টানি। এসব আর তখন মজা দিচ্ছিলো না। মন তখন খুঁজে পাচ্ছিলো অন্যতর উষ্ণতা।
শান্তিনিকেতন বাসের এক পর্যায়ে এসে হঠাত আমরা ঠিক করলাম যে প্ল্যানচেট করবো। এই আইডিয়াটা আসার পেছনে অবশ্য একটা কারন আছে। বা বলা যেতে পারে পটভূমিকা।
পৌষমেলা থেকে ফিরতি পথে, আমাদের কমপ্লেক্স আর শ্যামবাটির মোড়ের মধ্যে ছিলো একটা নির্জন গোছের পথ। শ্যামবাটির মোড় হচ্ছে সেই চৌরাস্তা যার একদিকে হাঁটলে আপনি পৌঁছবেন আশ্রমে, আরেকদিকে গেলে পড়বেন খোয়াইতে। সামনে সোজা গেলে গোয়ালপাড়া হয়ে রাস্তা মিশবে সিউড়ি যাওয়ার পাকা সড়কে আর চার নং রাস্তাটি শেষ হবে প্রান্তিক স্টেশনে। প্রান্তিক স্টেশনের একটু আগেই সোনার তরী কমপ্লেক্স। এই রাস্তাটাই রাত্তিরে হয় পড়তো নি:ঝুম। রাস্তার ডান হাতে সমান্তরালে বয়ে চলা ময়ুরাক্ষী খালের থেকে উঠে আসতো কুয়াশা। ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্টের সাথে জোনাকীদের ব্যালে দেখা যেতো। অপর পাড়ের ঝুপসি জঙ্গল ভেদ করে সীমান্তপল্লীর কুঁড়েঘরের দু একটা টিমটিমে আলো ছাড়া ছিল অখন্ড অন্ধকার।শুক্লপক্ষ হলে আকাশ দিয়ে শনশন করে উড়ে যেতো পরিযায়ী পাখি। কৃষ্ণপক্ষে শোনা যেতো প্যাঁচার ডাক। এর সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা মিলিয়ে পরিস্থিতি দস্তুরমতো রোমাঞ্চকর করে তুলতো। এমনই এক রাতে মেলার মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে আলোচনা হচ্ছিলো সামনের এই রাস্তাটা কোন নওজোয়ান একা হেঁটে পার হতে পারবে? দেখা গেলো কেউই এ ব্যাপারে পিছপা নয়। সকলেই আফ্রিকায় গিয়ে একা হাতে সিংহ শিকার কিম্বা বিন লাদেনকে লুডোয় হারিয়ে দেওয়ার মতো দুর্জয় ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে। তবে ইয়ে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় সাপখোপ, পোকামাকড়, ডাকাত গাঁটকাটা রয়েছে তাই...। আমরা সবাই যখন একে অন্যকে এই কথা বলে বেশ একটা সর্বদল সমন্বয় করছি হঠাত কথা নেই বার্তা নেই সন্দীপ খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বললো : আরে ছাড় ছাড়। সব একেকটা ভীতুর ডিম! কারো ইয়েতে ইয়ে নেই আবার বড় বড় বাতেলা? কি???? এও শুনতে হলো ? এ তো রজনীকান্তকে " Action জানেন" জিজ্ঞেস করা!!! শারুক্ষানকে রোমান্সের বিষয়ে লেকচার দেওয়া!!! অনু মালিককে অরিজিনাল সুর করতে পরামর্শ দেওয়া!!! না:। এই অপরাধের ক্ষমা নেই। সন্দীপ বাদে আমরা সবাই দাঁত কিড়মিড় করে ঠিক করলাম এর একটা বিহিত করতে হবে।
আগেই বলেছি যে রাস্তার ওপর দিয়ে সোনার তরী যাওয়া যায় সেটা বেশ নি:ঝুম। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট আছে বটে কিন্ত বালব নিখোঁজ। এটা দেখে আপনি জটায়ুর মতো " dacoits" বলে দু:খপ্রকাশ করতে পারেন কিন্ত কিছু করার নেই। তবে হাতে টর্চ থাকলে কোন চাপ নেই,আর সামনে সোনার তরীর আলো, ডানদিকে মেলার মাঠে আলোর আভা, সব নিয়ে মোটামুটি নজর চলে। তবে শীতকালে সরু নির্জন রাস্তা তো সরু নির্জন রাস্তাই। সুতরাং আমরা মোটামুটি একসাথেই হাঁটতাম। সন্দীপের ন্যক্কারজনক কথার পরে ঠিক হল, যে ওকে কৌশলে দলছাড়া করতে হবে। দেখা যাক ব্যাটা একা এই রাস্তা দিয়ে কিভাবে যায়। সেই মতো আমরা ওকে নানাভাবে তাতাতে শুরু করলাম। মানে " তুই পারবি একা হাঁটতে " থেকে শুরু করে " নিজে শালা অন্ধকারে মায়ের হাত ধরে চলিস " জাতীয় অপমান। এইভাবে সন্দীপের পৌরুষে ক্রমাগত ঘা দিতে দিতে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হলো। কয়েকটা কাঁচা খিস্তি র অলংকারে আমাদের ধন্য করে সে গটগট করে একাই হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। আমরাও ততোধিক আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। এইভাবে পাটিগণিতের নিয়মে আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। একটু পরেই সন্দীপের বাদামী জ্যাকেট আর দেখা গেলোনা আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর ভেসে এলো : তোরা কোথায়ায়ায়ায়।
যীশুখ্রীষ্ট বা বুদ্ধদেব দয়ার অবতার হলে কি হবে,তাদেরও কিশোরবেলা ছিলো। কেউ তো আর খোকা বয়েস থেকে দুম করে দামড়া হতে পারেনা। আর আমি হলপ করে বলতে পারি সেই লেভেলের কেউ আজ আমাদের মধ্যে থাকলেও এই ডাকে সাড়া দিতেন না। কারন দেশে দেশে যুগে যুগে আঠারো বছরের ছেলেপুলেদের কেউ এই চরম খিল্লির সুযোগ ছাড়ে না। যারা ছাড়ে তাদের ডাক্তার দেখানো উচিৎ। সুতরাং আমরা চুপ করে থাকলাম। সন্দীপ আবার ডাকলো। এবারে " ওরেএএএ" বলে হাহাকার। আমরা তবুও চুপ। তৃতীয়বার চরাচর ভেদ করে সন্দীপের যেই : শালা শুয়োরের..." শুরু হয়েছে,ঝপাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। সোনার তরী ব্ল্যাক আউট,মেলার মাঠের আলো ব্ল্যাক আউট, পেছনে শ্যামবাটির মোড়ে শ্যাম বাটি বা মোড় - কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। সেই ঘনান্ধকার পরিবেশ আরো জমাটি করে "ক্র্যাও, ক্র্যাও" আওয়াজে মাথার ওপর দিয়ে একটা রাতচরা পাখি উড়ে গেলো। আমরা একটু ঘাবড়ে গেলেও একসাথে আছি বলে মোটামুটি সামলে নিলাম। কিন্ত সন্দীপ? তার কি হলো? কোন সাড়াশব্দ নেই কেন? আমরা মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে পড়িমরি করে দৌড়লাম। কিন্ত সে কোথায়? রাস্তার উপরে তো নেই। খালের দিকে নেমে গেলো নাকি অন্ধকারে? হয়তো রাস্তার বাঁক বুঝতে না পেরে সোজা এগিয়ে গেছে সামনের বনবাদাড়ের দিকে। কিন্ত আমাদের সমস্বর হাঁকডাক শুনেও তার কোন পাত্তা নেই কেন? হঠাত রাস্তার বাঁদিকে নজর গেলো। সেখানে কিছু জঙ্গুলে গাছ আর আগাছা মিলে বেশ একটা ঘেরাটোপ তৈরি করেছে। তার ভেতর থেকে কেমন খচমচ আওয়াজ ভেসে আসছে না? ওরে বাবা!! কেয়ারটেকারের কাছে শুনেছিলাম ধারেকাছে নাকি একটা খ্যাপা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে কি...। ঝোপের পেছন থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। আমরা যে যা পারলাম ইঁট বা গাছের ডাল বাগিয়ে ধরলাম। সেই কড়া ঠান্ডার মধ্যেও কপালে বিনবিনে ঘাম দেখা দিলো।ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সোনার তরীর পেছন থেকে উঁকি মারলো শুক্লপক্ষের ফুটফুটে চাঁদ। আর আমরা দেখলাম... ও হরি!!! এ যে হতভাগা সন্দীপ। মুখ চোখের অবস্থা শোচনীয়। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক। কেস কি?
আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য তার মধ্যে বিশেষ কোন হেলদোল দেখা গেলনা। সবার দিকে একবার কটমট করে আবার সামনের দিকে হাঁটা দিলো সে।
সোনার তরীতে পৌঁছলাম। চারিদিকে অখন্ড লোডশেডিং। খাওয়াদাওয়ার পাট আগেই চুকিয়ে দিয়েছিলাম,তাই আলোর বিশেষ প্রয়োজন ছিলোনা। জামাকাপড় খুলে হিসু করে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়লেই হয়। কিন্ত আমাদের মাথায় তখন খেলছে অন্যকিছু। শীতের রাত।লোডশেডিং। চারিদিক চুপচাপ। এ কিসের আদর্শ পরিবেশ? বরাবরের মতো এবারও অনির্বাণ প্রকাশ করলো সবার মনোবাসনা।
- চল। প্ল্যানচেট করা যাক।
বাস্তবিক মনেই হচ্ছিলো যে আজকের নির্জনতা কেমন অপার্থিব গোছের। লোডশেডিং হওয়া এমন কিছু নতুন ব্যপার তো নয়। কিন্ত আজ যেন সবকিছু বড্ড বেশি থম মেরে আছে। যেন কেউ বা কারা চাইছে একটা যোগাযোগ হোক। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। তারপর আমি প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো ড্রয়ার থেকে বের করে আনলাম একটা মোমবাতি।ঘরের মাঝামাঝি একটা মোড়া টেনে নিয়ে এসে তার ওপরে সেটাকে স্থাপন করা হলো। সবাই বসলাম গোল হয়ে। সৌম্য দেশলাই জ্বালিয়ে প্রজ্জ্বলিত করলো মোমের শিখা। অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছটা অতিকায় ছায়া থরথরিয়ে কেঁপে বেড়াতে লাগল। সাত নাম্বার ছায়াটির মালিক অবশ্য ঘরে ঢুকেই জুতো মোজা খুলে কম্বলের তলায় সেঁধিয়েছে। দু একবার "ওরে সন্দীপ" ডেকেও তাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া গেলোনা। বাধ্য হয়ে আমাদেরই শুরু করতে হলো ওই পারের সাথে এক অলৌকিক যোগাযোগ।
প্রথম সমস্যা হলো কিভাবে প্ল্যানচেট শুরু করা যায়। মিডিয়াম থাকলে অবশ্য কাজটা সহজ হতে পারে,কিন্ত একজন মিডিয়াম হতে গেলে যে মানসিক গঠন দরকার ( মানে যেটুকু পড়েছি আর কি) সেটা আমাদের কারুর মধ্যে নেই। আরো একটা উপায় আছে। কোন কাপ অথবা বাটি জোগাড় করে সেটা একটা টেবিলের ওপর রেখে তারপর আহবান করা। টেবিলের উপরে হ্যা অথবা না লিখে মোটামুটি কথোপকথন চালানো যেতে পারে। অবশ্য চক দিয়ে A থেকে Z অব্দিও লেখা যায় এবং আলাপচারিতা বেশ ভালোভাবেই হয়,কিন্ত তাতে প্রচুর সময়ের অপচয় হবে। আমাদের কেমন যেন মনে হচ্ছিলো যে যা করার এক্ষুনি করতে হবে,নইলে সংযোগ করতে পারা যাবেনা আর। ঘরে টেবিলের অভাব। তাই বাসন রাখার একটা ট্রাঙ্ক নিয়ে এসে তার ওপরেই একটা কাপ রাখা হলো। এইসব যোগাড়যন্ত্র করে একে অন্যের আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁইয়ে প্রস্তুতি শেষ হল।
এইবারে দ্বিতীয় সমস্যা। কাকে ডাকা হবে? কাছাকাছি প্রিয়জন কেউ?নাকি বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব? কোথাও একটা পড়েছিলাম যে অপঘাতে মৃত হলে আত্মা সহজে ধরা যায়। কিমাশ্চর্যম!!! আমি ঠিক এই কথাটা ভাবার সাথে সাথে যেন আমার চিন্তার সুতো ধরেই মৈনাক ফিসফিসিয়ে বললো : সোহমকে ডাকলে কেমন হয়?
সোহম। সোহম হালদার।আমাদের স্কুলের বন্ধু। বছর খানেক আগে দেশের বাড়ি কালনায় গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে মারা গেছে। আমাদের সবার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে তার মুখ। বন্ধুদের ডাকে সে কি না এসে পারবে?
- ওক্কে। সোহমকেই ডাকছি আমরা।
শান্তনু ঠান্ডা গলায় বললো।
অত:পর সেই মৃত্যুশীতল রাতে একটি মাত্র মোমবাতির আলোর সামনে ছটি সম্মোহিত অস্তিত্ব সোহম হালদারকে ডাকতে লাগলো,যে অনেক দুরের পথে পাড়ি জমিয়েছে। আমরা চোখ বন্ধ করে সোহমের মুখটা মনে করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। একটা গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। কেয়ারটেকার ঢোকার সময়েই বলছিলো কোথাও একটা ট্রান্সফরমার ফেটেছে তাই আলো আসতে অনেক রাত হবে। সেটা কি সত্যি? নাকি এর পেছনে অন্য কোন সংযোগ আছে। কেয়ারটেকারের মুখটা অন্ধকারে ঠিক খেয়াল করিনি। ওর গলাটা কি রকম অন্যধাঁচের লেগেছিল না? তার মানে সবই কি আগে থেকে ঠিক করা? আমরা কি চালিত হচ্ছি? এই স্ক্রিপ্ট আগে থেকেই লেখা ছিলো। শুধু...
একটা খট খট আওয়াজে চোখ খুলতে হলো। দৃষ্টি চলে গেল কাপটার দিকে। ওটার মধ্যে কেমন একটা স্পন্দন দেখা যাচ্ছেনা? যেন সেটা একটা ইঁদুরের মতো জীবিত কিছু।
- সোহম, তুই কি এসেছিস?
জিজ্ঞেস করলাম খুব কষ্টের সাথে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
কাপের ঠকঠকানি আরো বাড়তে লাগলো। আমরা বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রাঙ্কের উপরে সেটা প্রায় নেচে বেড়াচ্ছে এখন।
- সোহম, সোহম তুই কি এসেছিস? তুই এসে থাকলে হ্যাঁ লেখাটার উপর কাপটাকে নিয়ে আয়।
বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কথাগুলো আমি নিজে বলছি। কোন সন্দেহ নেই যে আমাকে এখন চালিত করছে অন্য কেউ। হয়তো আমাদের সবাইকে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে কিন্ত কিছু করার নেই আর।
কাপের ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর সেটা আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো হ্যাঁ এর দিকে। কিন্ত একি? মাঝখানে রাস্তা পালটে সেটা না এর দিকে যাচ্ছে কেন? তাহলে কি সোহম আসেনি? প্ল্যানচেট করার সময়ে অনেক সময় এমন আত্মা চলে আসে যে অবাঞ্ছিত । এটা খেয়াল ছিলোনা আমার। সে রকম কিছু নয়তো? এবার কি হবে? বারবার চেষ্টা করলাম সরে আসতে। চেষ্টা করলাম কাপটাকে আছড়ে ভাঙতে। কিন্ত একটা ইঞ্চি নড়তে পারলাম না। বাকীরা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেন? কেন? ঠিক এই সময় দেখলাম ঘরের দেওয়ালে নতুন আরেকজনের ছায়া পড়েছে। সাত নাম্বার ছায়া। কিছু বুঝতে পারার আগেই একটা শরীর আমার পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো মোমবাতিটার উপর। সঙ্গে সঙ্গে শনশন করে হাওয়া বয়ে গেলো আর চারিদিক ঢেকে গেলো অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের ভেতরে মহা আতঙ্কে দেখতে পেলাম....।
না:। কিছুই দেখতে পাইনি। কোন ঘটনাই ঘটেনি। কোন প্ল্যানচেট করিনি আমরা। ভেবেছিলাম করবো। মোমবাতি একটা ছিল। লোডশেডিং ছিলোনা,তবে ঘর অন্ধকার করে বসার ইচ্ছে ছিলো। কিন্ত এইসব কথাবার্তা হওয়ার সময়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সন্দীপ হঠাত লাফ দিয়ে নেমে এসে আমার হাত থেকে মোমবাতিটা কেড়ে নিয়ে মটমট করে সেটা ভেঙে ফেলে জানালা দিয়ে বিসর্জন দিয়ে আবার কম্বলে গিয়ে সেঁধোয় আর আমাদের প্ল্যানচেট করার আশা সেখানেই ধুক করে নিভে যায়।
আমরা কোন প্ল্যানচেট করিনি।
কেয়ারটেকারও বদল হয়নি সেই রাতে।
সোহম হালদার বলে কেউ ছিলনা।